গত ৩৪ বছরে রাজ্যের কর্মসংস্কৃতির যা হাল হয়েছিল, তা ফেরাতে এখন উদ্যোগী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারি কাজে হস্তক্ষেপ করে কোনও উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা তৈরি করা যাবে না৷ নিজের পছন্দমতো ঠিকাদার বা নিজের লোক ঢোকানোর প্রবণতা যেসব নেতার রয়েছে, তাঁদের উদ্দেশেই এই বার্তা৷ এইসব করলে পরেরবার মিলবে না টিকিট৷ লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী৷
দলের সাম্প্রতিক নীতি নির্ধারণ কমিটির বৈঠকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে এযাবত্ সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ বার্তাটি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সরকারি প্রকল্পের কাজে কোনওরকম হস্তক্ষেপ দলীয়স্তরে বরদাস্ত করা হবে না বলে তিনি তাঁর সতীর্থদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন৷ রাজ্যের শিল্প ও বণিকমহল মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তাকে রাজ্যের উন্নয়নের পক্ষে খুবই সদর্থক পদক্ষেপ হিসাবে দেখতে শুরু করেছে৷ সাধারণ রাজ্যবাসীর কাছেও এই বার্তা খুবই উত্সাহব্যঞ্জক৷
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর গত পাঁচ বছরে রাজ্যে চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন হয়েছে৷ এই কথা অস্বীকার করবেন না তাঁর প্রবল বিরোধীরাও৷ এক সিপিএম নেতার মুখেই শুনেছি, “আমাদের অনেক ‘লায়াবিলিটি’ ছিল৷ বটগাছের যেমন ঝুড়ি নামে, তেমন৷ ওঁর কাজ করার ক্ষেত্রে সুবিধা হল ওঁকে এই ‘লায়াবিলিটি’ বহন করতে হয় না৷” সিপিএম নেতাটি বোঝাতে চাইছিলেন, দলীয় বাধাতেই তাঁরা উন্নয়নের কাজ পুরো মাত্রায় করতে পারেননি৷ দলীয় বাধা মানে বিভিন্ন্ ক্ষেত্রে দলের শ্রমিক সংগঠন, কর্মী সংগঠন ও স্থানীয়স্তরে নেতাদের বাধা৷ ১৯৮৭ সালে বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যে প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া দেখেই সিপিএম নেতারা বুঝেছিলেন, মানুষের প্রত্যাশা মতো উন্নয়নের কাজ করতে না পারলে ক্ষমতা ধরে রাখা যাবে না৷ সেইসময় থেকেই দলের ভিতরে কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর প্রচার শুরু হয়৷ দলের এক অর্থনীতিবিদ সাংসদ দলীয় একটি পত্রিকাতে লেখেন, দলের বহু কর্মীই কর্মস্থলে নিজের কাজ ঠিক মতো করেন না৷ কেন কাজ করছেন না জিজ্ঞেস করা হলে তাঁরা বলেন, দেশে বিপ্লব হলে তারপর তাঁরা কাজ করবেন৷ যাঁরা এই কথা বলেন, তাঁরা বিপ্লবের পরেও কোনও কাজ করবেন না বলে সাংসদ তাঁর লেখায় ব্যঙ্গ করেছিলেন৷ দলীয়স্তরে এইসব প্রচার চালিয়েও আলিমুদ্দিনের নেতারা কাজের কাজ কিছুই করতে পারেননি৷ বাম আমলে রাজ্যের কর্মসংস্কৃতির একচুল উন্নতি হয়নি৷ বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও মুখ থুবড়ে পড়েছিল৷
এই রাজ্যে কর্মসংস্কৃতি নষ্ট করার ক্ষেত্রে সিটু-র মতো বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গে কোঅর্ডিনেশন কমিটিও সমান দায়ী ছিল৷ জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা এদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস দেখাতেন না৷ কারণ এরাই নাকি তাঁদের ভোটে জেতাতো৷ সিপিএম নেতাটি ‘লায়াবিলিটি’ বলতে এদেরই ইঙ্গিত করছিলেন৷ সরকারের নানা কাজে বাধা আসত স্থানীয়স্তরে সিপিএম নেতাদের তরফেও৷ একসময় সিপিএমের লোকাল কমিটির সম্পাদকদের বলা হত–স্থানীয় থানার ওসি৷ জেলা সম্পাদকরা হাবেভাবে একেকজন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন৷ তাঁর এলাকায় সরকারি কাজ কী হবে, কে করবে–সেসব তাঁরাই ঠিক করতেন৷
তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম পাঁচ বছরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় নিয়ন্ত্রণের ফাঁস থেকে পুলিশ ও প্রশাসনকে মুক্ত করেছেন৷ দ্বিতীয় দফার গোড়া থেকেই ফের কড়া অবস্থান নিতে শুরু করেছেন তিনি৷ দলের নেতাদের সভাতে যেভাবে সকলকে সতর্ক করেছেন তা খুবই তাত্পর্যপূর্ণ৷ তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারি কাজে হস্তক্ষেপ করে কোনওভাবেই কোনও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে বাধা তৈরি করা যাবে না৷ নিজের পছন্দমতো ঠিকাদার বা নিজের লোক ঢোকানোর প্রবণতা যে সমস্ত নেতার রয়েছে, তাঁদের উদ্দেশেই তাঁর এই বার্তা৷ এইসব করলে পরেরবার টিকিট মিলবে না বলেও সাংসদ, বিধায়কদের বুঝিয়ে দিয়েছেন৷ দীর্ঘ বাম জমানায় কখনওই এইভাবে কঠোর হতে দেখা যায়নি জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুদের৷ তাঁরা বড়জোর দলের নেতাদের কাছে অনুনয়-বিনয় করতেন৷
এ মাসের গোড়ায় বাম শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা বন্ধ যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী মোকাবিলা করেছেন তা অভাবনীয়৷ সরকারি দফতরগুলিতে হাজিরা প্রায় ১০০ শতাংশ ছিল৷ সরকারি কর্মীদের মধ্যেও তো বহু কট্টর বামপন্থী রয়েছেন৷ কিন্তু তাঁরাও মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করার সাহস দেখাননি৷ কর্মসংস্কৃতি নিয়ে আমাদের রাজ্যের বরাবরের দুর্নাম রয়েছে৷ এই দুর্নাম ঘোচাতে হলে মুখ্যমন্ত্রীর এইরকম কড়া অবস্হানই জরুরি৷ বাম আমলে নানা রাজনৈতিক বাধায় উন্নয়নের কাজ সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ উদার অর্থনীতির এই সময়ে পরিকাঠামো উন্নত না হলে রাজ্যে লগ্নি টানা সম্ভব নয়৷ কারণ লগ্নি টানা নিয়ে রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা৷ এই অবস্হায় উন্নয়ন ও পরিকাঠামোর কাজ অনেক দ্রূত শেষ করতে হবে৷ তৃণমূল সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে যেটা সম্ভব হয়েছে৷ দ্বিতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী যে এই কাজে আরও গতি চাইছেন তা তাঁর এই কঠোর মনোভাব থেকেই বোঝা যাচ্ছে৷ দেশের শিল্পমহল তাই স্বাভাবিকভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক করা মন্তব্যে উত্সাহিত৷ পূর্ব ভারতের তো বটেই, গোটা পূর্ব এশিয়ার ‘গেটওয়ে’ এখন বাংলাকে বলা হচ্ছে৷ বাংলার উন্নতি যত দ্রূত হবে, তত দ্রূত হবে পূর্ব ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি৷ বাংলার অগ্রগতি পূর্ব এশিয়ায় দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে৷ যা আবার দেশের সাম্প্রতিক আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত৷ মুখ্যমন্ত্রী বাংলাকে পূর্ব এশিয়ার গেটওয়ে করার সুযোগটি আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করতে চাইছেন৷ তাঁর এই উদ্যোগের পাশে দাঁড়ানো এখন প্রতিটি রাজ্যবাসীর কর্তব্যের মধ্যেই পড়া উচিত৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.