শালবনিতে চলছে ছবিতে চলছে মহিষাসুরের কাঠামো তৈরির কাজ।
সম্যক খান, মেদিনীপুর সদর: শুনলে চমকে ওঠারই জোগাড়। দেবী দুর্গা অসুর হিসেবে যাকে বধ করেছিলেন সেই মহিষাসুরের পুজো করছেন ওঁরা। নানা অকথিত কাহিনী তুলে ধরা হবে ওঁদের সমাজের মানুষজনের কাছে। ওঁরা মানে আদিবাসী, কুরমি সম্প্রদায়ের একাংশ। দুর্গা নয়, মহিষাসুরকেই দেবতাজ্ঞানে মনে মনে পুজো করেন তাঁরা। এখনও মনে করেন যে, তাঁদের ‘হুদুড় দুর্গা’ তথা মহিষাসুরকে প্রকৃত যুদ্ধের মাধ্যমে পরাস্ত করা হয়নি। নীতিহীন যুদ্ধে পরাস্ত করে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল। তাই আদিবাসীরা আজও মহিষাসুরকেই দেবতা বলে মানেন। আর সেই বিশ্বাসকে ভর করেই গত বছর থেকে প্রকাশ্যে ওই স্মরণসভার আয়োজন করা হচ্ছে।
স্মরণসভা উপলক্ষে রীতিমতো মহিষাসুরের মূর্তি গড়া হয়। ওই মূর্তির সামনেই অতীত ইতিহাস তুলে ধরেন আদিবাসী সমাজের মাথারা। শালবনির কেন্দাশোল প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ওই অসুর স্মরণের আয়োজন করেছে এমকে খেরয়াল রাস্কৌ মহল। সপ্তমীর দিনই হচ্ছে ওই পুজো। এজন্য বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মূর্তি গড়ারও কাজ চলছে জোরকদমে। শুধু তাই নয়, ওইদিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি শিশু ও মহিলাদের নিয়ে নানা প্রতিযোগিতারও আয়োজন করেছেন উদ্যোক্তরা। সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা কৃষ্ণকান্ত মাহাতো, সভাপতি রাজু সোরেন, সম্পাদক কমল হাঁসদা, রাম হাঁসদা, তাঁরা আজও মনে করেন যে, আদিবাসীদের আদি পুরুষ ‘হুদুড় দুর্গা’ তথা মহিষাসুর এক বিদেশি আর্য রমনীর দ্বারা অন্যায়ভাবে নিধনের ফলে ভারতের ভূমিপুত্র আদিবাসী খেরওয়ালরা দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারিয়েছিল। ইতিহাস থেকে তাঁরা জেনেছেন, মহিষাসুরকে নীতিহীন যুদ্ধে পরাস্ত করে আর্যাবর্ত নামে আর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আর্যপক্ষ যখন বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছিল, সেই সময় সাঁওতাল, মুণ্ডা, কোল, কুর্মি, মাহালী, কোড়া প্রভৃতি খেরওয়াল গোষ্ঠীর আদিবাসীরা তাদের বশ্যতা স্বীকার না করে নিজেদের মান বাঁচানোর উদ্দেশে নারীর ছদ্মবেশে দাঁশাই নাচ ও কাঠিনাচের মাধ্যমে অন্তরের দুঃখ নিয়ে আনন্দের অভিনয় করতে করতে সিন্ধুপার ছেড়ে অসম, কাছাড়, ঝাড়খণ্ড, উড়িশার ও দক্ষিণ ভারতের বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। সেই মহান রাজার নিধন ও দেশ হারার বেদনা বুকে নিয়ে সেই থেকেই আদিবাসীরা তাদের পিতৃপুরুষ মহিষাসুরের স্মরণে ‘হায়রে হায়রে’ শব্দযোগে আজও দাঁশাই নাচ ও কাঠি নাচ করে চলে।
সাঁওতালি দাঁশাই এর বিধি অনুযায়ী ওইসময় পাঁচদিন দুর্গা দেবীর মুখ দর্শন বন্ধ ছিল। এখনও অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী শোক পালন করতে গিয়ে ওই দিনগুলিতে বাড়ি থেকে বের হন না। আদিবাসীদের একাংশের মতে, দুর্গোৎসবের মতো উৎসবকে সাম্রাজ্যবাদীর তকমা দিয়ে প্রকৃত ইতিহাস চাপা দেওয়ার চেষ্টায় উচ্চবর্ণীয় পণ্ডিতরা ধর্মের রং মিশিয়ে মহিষাসুরকে অশুভ শক্তি হিসেবে মিথ্যা প্রচার করেন। তাঁরা মনে করেন, এই দুর্গোৎসব শুভ শক্তির পরাজয় ও অশুভ শক্তির জয়ের পুজো। তাই আদিবাসীরা মহিষাসুরকেই আসল দেবতা মনে করে সপ্তমীর দিন স্মরণ করে শহিদ দিবস পালন করে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.