অর্ণব আইচ: ‘জঙ্গি বিনিময়৷’ নাশকতা ও হামলার জন্য চাই নতুন মুখ৷ তাই এই দেশ থেকে কিছু ‘নতুন মুখ’কে চোরাপথে সীমান্ত পেরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে৷
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা একটি রিপোর্টে জানিয়েছেন যে, এই রাজ্য হয়েই চোরাপথে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে কিছু যুবককে৷ তাদের কোনও হামলা বা নাশকতার কাজে লাগানো হতে পারে৷ এভাবে আরও কয়েকজন তরুণ ও যুবককে বাংলাদেশে পাঠানোর ছক কষা হয়েছে৷ বাংলাদেশে তারা সম্পূর্ণ অপরিচিত৷ ‘র্যাব’ বা বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তাদের পরিচয় জানেন না৷ তাদের দিয়ে কোনও নাশকতা করানো হলেও প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের পক্ষে তাদের চিহ্নিত করা সহজ হবে না৷ আবার একইভাবে বাংলাদেশে পলাতক কিছু জঙ্গিকে সীমান্ত পেরিয়ে পাঠানো হয়েছে এই রাজ্যে৷
ঢাকার গুলশন এলাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের হাতে ২০ জন বিদেশি খুনের পর এই রিপোর্টটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে৷ যদিও এই দেশ থেকে পাঠানো ওই যুবকরাই যে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি৷ তার উপর ‘জঙ্গি বিনিময়’-এর ফলে বাংলাদেশ থেকে যে জঙ্গিরা প্রবেশ করছে, তাদের নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গোয়েন্দারা৷ কারণ, ওই জঙ্গিরা প্রশিক্ষিত৷ তাদের মধ্যে অনেকেই ‘বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ’৷ তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণও রয়েছে৷ ঢাকায় হামলকারীদের মধ্যে কাউকে এভাবেই সীমান্ত পার করে এই রাজ্যে পাঠানো হয়েছে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না৷ তারা কলকাতা বা তার আশপাশের কোনও জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে, এমনও সম্ভব৷ এই দেশ বা রাজ্যের কোথাও তারা কোনও নাশকতার ছক কষছে কি না, সেই বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন এনআইএ আধিকারিকরাও৷
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে আসা খবর অনুযায়ী, এই ‘জঙ্গি বিনিময়’-এর পিছনে মূলত রয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর মদতপুষ্ট জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-র জঙ্গিরাই৷ বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, রাজশাহি, খুলনা, ময়মনসিংহ-সহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে জেএমবি জঙ্গিদের গোপন ঘাঁটি৷ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসে জেএমবি-র নেতারা বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, নদিয়ায় ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র তৈরি করে৷ ২০১৪ সালের অক্টোবরে খাগড়াগড়-কাণ্ডের পর রাজ্য পুলিশের সিআইডি ও কেন্দ্রীয় সংস্থা এনআইএ এই রাজ্যে জেএমবি-র ঘাঁটি ভেঙে দেয়৷ তবু পলাতক জেএমবি জঙ্গি নেতারা নতুন মডিউল তৈরির চেষ্টা করেছে৷ জেএমবি-র প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যে তরুণরা প্রশিক্ষণ নিয়েছিল, তারাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে৷ এ ছাড়াও পলাতক অবস্থায় যে বোমারু মিজান ওরফে কওসর, হাতকাটা নাসিরুল্লা, মৌলানা ইউসুফ, বোরহান শেখ, তালহা শেখের মতো জেএমবি নেতারা বহু তরুণের মগজধোলাই করেছে, সেই প্রমাণ মিলেছে৷ তাদের মধ্যে থেকেই কয়েকজনকে পাঠানে হচেছ বাংলাদেশে৷ এদের পরিচয় জানেন না বাংলাদেশের গোয়েন্দারা৷ অপরিচিত তরুণদের দিয়েই যে বাংলাদেশে হামলার ছক হতে পারে, সেই বিষয়ে আগেই রিপোর্ট দিয়ে সতর্ক করেছিলেন গোয়েন্দারা৷ তাঁরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ওই তরুণদের পরিচয় ফাঁস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই দেশে ফেরত পাঠানোরও ছক কষেছে জেএমবি৷
তবে জঙ্গি অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে প্রথম ‘ভিলেন’ জেএমবি হলে, দ্বিতীয় ‘ভিলেন’ অবশ্যই বর্ষা৷ গোয়েন্দাদের মতে, এমনিতেই সীমান্ত এলাকার নদীপথ পেরিয়ে বর্ষাকালেই অনুপ্রবেশ পছন্দ জঙ্গিদের৷ জইশ-ই-মহম্মদের জুবের, সোহেল থেকে শুরু করে আইএসআই এজেন্ট ইজাজ উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্তে নদী পেরিয়েই অনুপ্রবেশ করেছে এই রাজ্যে৷ নদিয়ার সীমান্ত অঞ্চলেও নদী পেরিয়ে চলে অনুপ্রবেশ৷ বর্ষা নামলেই মুর্শিদাবাদের লালগোলার লবণগোলার উল্টোদিকেই ফরওয়ার্ড চর, চর বিনপাড়া, টিকলিচর, নির্মলচর, মদনঘাট ডুবতে থাকে জলে৷ চরের কোথাও দুই, কোথাও বা ছয় ফুট জল৷ চর পেরোলেই বর্ষায় ভরা পদ্মা নদী৷ বাংলাদেশের রাজশাহির প্রেমটুলি বা চরকানাপাড়া থেকে অনুপ্রবেশকারীরা এই সময়ই পদ্মা পেরিয়ে আসে ওই জলে ভরা চরগুলিতে৷ এখানে তৈরি থাকে রবিউল ওরফে গরিবুল্লা, আলামেন, সাদ্দামের মতো এজেন্ট ও ‘লাইনসম্যান’দের ছোট নৌকা বা ডিঙি৷ সন্ধ্যার পর অনুপ্রবেশকারীদের লুকিয়ে রাখা হয় এলিফ্যাণ্ট ঘাস ভরা উঁচু জায়গায়৷ রাতের অন্ধকারে বিএসএফ-এর চোখ এড়িয়ে তাদের নিয়ে আসা হয় মুর্শিদাবাদের মূল ভূখণ্ডে৷ বাংলাদেশের হাপনিয়া, নিতপুর, রোকহানপুর, বিবিশান এলাকা থেকেও ফাঁকা সীমান্ত পেরিয়ে কখনও অনুপ্রবেশ হয় মালদহের পান্নাপুর, টিক্কাপাড়া, কেদারিপাড়া, হরিশ্চন্দ্রপুর, ভবানীপুর, কোতুলপুর, ইটাঘাঁটি, বেলডাঙার সীমান্তেও৷ ওই অনুপ্রবেশ রোখা ও জঙ্গিদেরও চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বিএসএফ-এর গোয়েন্দারা৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.