দেবব্রত দাস, খাতড়া: পুজোর ঘটে প্রতিমার আগমনের চিহ্ন হিসেবে দেবীর পদচিহ্ন, সন্ধিপুজোর সময় ঘট থেকে ফুল পড়ে যাওয়া। এসবই ইঙ্গিত দেয়, এ বাড়িতে দেবী দুর্গা বিরাজমান। বাঁকুড়ার তালডাংরা ব্লকের শালতোড়া গ্রামে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ২০০ বছরের দুর্গাপুজো ঘিরে এমনই সব অলৌকিক ঘটনা ঘটে থাকে বলে জনশ্রুতি।
দ্বিশতাব্দী প্রাচীন এই পুজোকে কেন্দ্র করে এলাকার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে বেজে ওঠে একতার সুর। তালডাংরা ব্লকের সাবড়াকোন পঞ্চায়েতের বর্ধিষ্ণু গ্রাম শালতোড়া। সাবড়াকোন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। গ্রামে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় মূলত বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়ের পাশাপাশি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষজনের বসবাস। প্রচলিত রয়েছে, গ্রামের ব্রাহ্মণপাড়ায় একটি মন্দির স্থাপন করে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন এই গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের পূর্বপুরুষরা। প্রায় ২০০ বছর আগে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল বলে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান বংশধরদের দাবি। সেই পুজোয় আজও হয়ে আসছে বংশ পরম্পরায়। মাতৃ আরাধনার গত বছর গড়ে উঠেছে নতুন মন্দির।
কীভাবে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল?শালতোড়া গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের প্রবীন সদস্য অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়রা বলেন, “আমাদের বাবা, ঠাকুরদাদের মুখে শুনেছি, বহু বছর আগে গ্রামে কোনও দুর্গাপুজো ছিল না। গ্রামের মানুষকে পুজো দেখতে অনেক দূরের গ্রামে ছুটতে হত। গ্রামের মানুষ দূর থেকেই ঢাকের আওয়াজ শুনতেন। তখন আমাদের পূর্বপুরুষ ভৈরব ভট্টাচার্য দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন। আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের পদবি ছিল ভট্টাচার্য। এখন আমাদের পদবি বন্দ্যোপাধ্যায়। পূর্বপুরুষরা একজোট হয়ে মন্দির তৈরি করেন। মন্দিরের সামনে আবিরের সুন্দর নকশা করা থাকে।পুজোর ঘট আনার সময় সেখানে মায়ের ছাপ দেখা যায়।”
বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান বংশধর সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, জয় বন্দ্যোপাধ্যায়রা জানালেন, “সপ্তমীর সকালে ব্রাহ্মণবাড়ির পুরুষরা ধুতি পড়ে, মহিলারা শাড়ি পরে গ্রাম লাগোয়া মুড়াকাটির নদী থেকে শোভাযাত্রা সহকারে ঘট নিয়ে আসেন। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িতে রান্না হয় না। মন্দিরে অন্নভোগ রান্না হয়। পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে পাত পেড়ে খান। নবমীর দিন দুপুরে গ্রামের হাজারখানেক মানুষজনকে খিচুড়ি ভোগ খাওয়ানো হয়। আমাদের পুজোয় পশুবলি হয় না। সন্ধিপুজোয় চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। লক্ষ্মীপুজোর পরে প্রতিমা বিসর্জন করা হয়। আগের মতই পুজোর সময় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। দ্বাদশীর রাতে গ্রামের মানুষজন যাত্রাপালা করেন। জাঁকজমক সহকারে পুজো হয়। পরিবারের অনেক সদস্য কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন বর্তমানে। পুজোর সময় সকলেই গ্রামে ফিরে আসেন মায়ের টানে। সাধ্যমত পুজোর খরচ দেন সকলেই”।
এই দুর্গাপুজোই মিলিয়ে দেয় শালতোড়া গ্রামের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে। একসূত্রে গাঁথে গোটা পরিবারকে। ঐতিহ্যের এই পুজো যেন পারিবারিক মেলবন্ধনের অপূর্ব দৃষ্টান্ত। জয়বাবু বলেন, “এই পুজোকে কেন্দ্র করে গোটা গ্রামের মানুষ একত্রিত হচ্ছেন। এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। ফি বছর এই পুজোর অপেক্ষায় থাকি আমরা।” আর এখানে দেবীমাহাত্ম্যের অলৌকিক সব ইঙ্গিত সবচেয়ে বড় আকর্ষণ শালতোড়া গ্রামের দ্বিশতাব্দী প্রাচীন পুজো।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.