ব্রতীন দাস, শিলিগুড়ি: অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা ছুটি পেলেই ছিপ হাতে চলে যান মাছ ধরতে। বড়শিঁতে রুই-কাতলা গাঁথার নেশায় রীতিমতো গাঁটের কড়ি খসিয়ে টিকিট কাটেন। কারও আবার রোববার ছুটির দিনে বাজারের সেরা মাছটা কেনা চাই-ই। কারও পছন্দ চুনো মাছের চচ্চড়ি তো কারও আবার সরষে বাটা ইলিশ কিংবা চিংড়ির মালাইকারি। এহেন ‘মৎস্যপ্রেম’–কে হাতিয়ার করেই রাজ্যে এবার ফিশ ট্যুরিজম। মাছের সঙ্গেই নির্ভেজাল দু’দিন এক রাত। একেবারে অন্যরকম এই ভ্রমণের উদ্যোক্তা রাজ্যের ফিশারি ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন। শুধু বাংলার পর্যটকরাই নন, এতে সাড়া দিচ্ছেন বিদেশি টুরিস্টরাও।
[ফের দিঘার মোহনায় বিশালকার মাছ, নিলামে রেকর্ড দর]
এই ভ্রমণের আদি-অন্ত সবটাই মাছ। ছিপ দিয়ে কিংবা জাল ফেলে ইচ্ছেমতো মাছ ধরা। তারপর সেসব মাছের মনপসন্দ ডিশ বানিয়ে তা দিয়ে লাঞ্চ, ডিনার। চাইলে ব্রেকফাস্টেও মিলতে পারে। শুধু কি তাই! মাছ দেখা, মাছ ধরা, মাছকে খেতে দেওয়া, মাছের ছবি তোলার সুযোগ। সঙ্গে মাছের ইতিবৃত্ত থেকে রন্ধনপ্রণালী-জেনে নেওয়া যাবে সবই। বেড়াতে গিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা এবং রয়েছে পুরস্কার জেতার সুযোগও।
কেরলের ধাঁচে ব্যাক ওয়াটারকে কাজে লাগিয়ে ফিশ ট্যুরিজমের মাধ্যমে সুন্দরবন, বকখালি অঞ্চলে পর্যটনের নয়া দিশা দেখানোর যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা শুরুতেই সফল। রাজ্য ফিশ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৌম্যজিৎ দাস বলেছেন, ‘‘গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে পর্যটকরা আসছেন। বিদেশ থেকেও ভাল সংখ্যায় টুরিস্ট বাংলার ফিশ ট্যুরিজমে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। মাসে গড়ে ৪০ লক্ষ টাকা আয় হচ্ছে’’।
গত মে মাস থেকে সূচনা হলেও পুরোদমে চালু হয়ে গিয়েছে চলতি ডিসেম্বরে। সুন্দরবনের ফ্রেজারগঞ্জ হেনরি আইল্যান্ড থেকে বকখালির চন্দনপিরি। দিঘা, তাজপুর থেকে বর্ধমানের মেমারি, গুসকরার যমুনাদিঘি। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে উত্তরবঙ্গের তিস্তা-তোর্সা। কিংবা সল্টলেকের নলবন থেকে পূর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ জলাশয়, যা ইউনেস্কোর তরফে ইতিমধ্যে বিরল প্রাকৃতিক সাইট হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সবটা নিয়েই গড়ে উঠেছে ইকো ফিশ ট্যুরিজম সার্কিট। রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহার দাবি, “ফিশ টুরিজমে দারুণ সাড়া মিলছে। আপাতত আমরা দক্ষিণবঙ্গেই ঘোরাচ্ছি পর্যটকদের। তবে শীঘ্রই সার্কিটে থাকা উত্তরবঙ্গের জায়গাগুলিও ঘুরে দেখতে পারবেন তাঁরা।”
[মাঝ ডিসেম্বরে শীত শীত ভাব, এই ফাঁকে চুপিসারে চলুন ‘চুপি’]
চলতি বছরের এপ্রিলে সল্টলেকের নলবনে পাইলট প্রকল্প হাতে নেয় রাজ্য ফিশারিজ ডেভলপমন্টে কর্পোরেশন। সেখানেই পর্যটকরা ফিশ টুরিজমকে সানন্দে গ্রহণ করায় তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দু’দিন এক রাতের প্যাকেজ হিসাবে মাথা পিছু এই ফিশ ট্যুরিজমের জন্য খরচ চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। স্বাচ্ছন্দ্যের উপর প্যাকেজে টাকার পরিামণ কম-বেশি হতে পারে। পর্যটকদের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বাসে করে তুলে নিয়ে আসা থেকে গোটা সার্কিট ঘুরিয়ে দেখানো। বাসেই থাকছে মাছের নানা পদ দিয়ে ব্রেকফাস্ট, স্ন্যাক্স। তার পর স্পটে গিয়ে লাঞ্চ, ডিনারের ব্যবস্থা। টুরিস্টরা থাকতে পারবেন ফিশারি ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের গেস্ট হাউসে। স্পটে ঘোরার জন্য রয়েছে ব্যাটারিচালিত গাড়ি। এলাকা ঘুরে দেখার পাশাপাশি পর্যটকরা জলাশয় থেকে মাছ ধরতে পারবেন। তাঁদের ধরা মাছই সঙ্গে সঙ্গে রান্না করে দেওয়া হবে। ফিশারি ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা প্যাকেজ দিয়ে দেবে। এই মুহূর্তে চার রকমের প্যাকেজ চলছে।
[সমুদ্রপাড়ে তাঁবুতে রাত্রিবাস, এমন দিঘা কখনও দেখেছেন?]
ফিশ ট্যুরিজমে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে সুন্দরবন অঞ্চলে। যাতে পর্যটকরা সেখানে গিয়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্য, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, জীব বৈচিত্র্য, নদীর পাশাপাশি মাছ পালনও দেখতে পারেন। কাছ থেকে জানতে পারেন সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া মৎস্যজীবীদের জীবনকে। মাঝ সমুদ্রে তাঁদের অভিজ্ঞতা সরাসরি শুনে উপভোগ করতে পারেন রোমাঞ্চ। একসময় যাঁরা সুন্দরবন অঞ্চলে মীন কিংবা কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, সেসব মহিলাদের এই ফিশ ট্যুরিজমে যুক্ত করা হয়েছে। পর্যটকদের জন্য তাঁরাই মাছের হরেক পদ রান্না করে দিচ্ছেন। শোনাচ্ছেন জল-জঙ্গলের কাহিনী। সবমিলিয়ে ফিশ ট্যুরিজমকে কেন্দ্র করে এই শীতে বেড়ানোর মজাটাই আলাদা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.