বাবুল হক, মালদহ: গোলাপি ‘জালের’ স্রোতে মিশে গেল ৫০০ টাকার নোটও। এতদিন নতুন পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে তেমন আতঙ্ক ছিল না। বাজারে নতুন দু’হাজার টাকার নোটের জাল বেরিয়েছে অনেক দিন। নানা মহলে ধারণা ছিল পাঁচশোর নোটের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। সে গুড়ে বালি। এবার সীমান্ত টপকে মালদহে ঢুকে পড়েছে ৫০০-র জাল নোটও! আর এটাই নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্যের গোয়েন্দাদের। আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ী মহল। হতচকিত পুলিশ প্রশাসনও। ৫০০ টাকার জাল নোটের অন্তর্তদন্তে সংবাদ প্রতিদিনের প্রতিনিধি বাবুল হক।
[লণ্ঠন অন্ধকার, অসাধু চক্রের ‘হাতযশে’ কেরোসিনে চলছে বাস]
[চোখের সামনে বাইক উধাও, নেপথ্যে কোন চক্র সক্রিয়?]
মালদহ দিয়ে নোটের জাল
উৎস, রুট, করিডর, কিছুই বদলায়নি। কখনও পদ্মার উজানে, কখনও গঙ্গার জলপথে, তো কখনও আবার কাঁটাতার টপকে স্থলপথে মালদহের ভূখণ্ডে তা ঢুকে পড়ে। জালের স্রোত অব্যাহত মালদহে। সেই পুরনো জাল নোটের কারবারিরাও এবার নতুন উদ্যমে নেমে পড়েছে নয়া নোটের কারবারে। নোট বাতিলের মাস তিনেক পরই নয়া দু’হাজারি নোটের জাল টাকা উদ্ধার হয়। দেশের অন্য কোথাও নয়, সেই মালদহ জেলাতেই প্রথম নয়া গোলাপির জাল পাওয়া যায়। তারপর মুর্শিদাবাদ, কলকাতায় উদ্ধার হয় জাল দু’হাজারি নোট। নোটবাতিলের পর শুধুমাত্র মালদহ জেলা থেকেই পুলিশ, বিএসএফ ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ উদ্ধার করেছে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার জাল নোট। যার পুরোটাই ২০০০ টাকার নোট। কিন্তু এতদিন নতুন ৫০০ টাকার নোটের জাল নোটের দেখা মেলেনি। ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলাবলি করতেন, ‘জাল নোটের কারবারিরা দু’হাজারি জাল নোট বাজারে ছেড়েছে। ৫০০-র জাল নোট এখনও বাজারে ছাড়েনি।’ নয়া গোলাপি নোট হাতে এলেই অন্তত পাঁচ-সাতবার পরখ করে নেওয়াটা কার্যত বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাল কি না, তা উলটে-পালটে দেখে নিতে হচ্ছে। তবে নতুন পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে ব্যবসায়ীরাও সেভাবে মাথা ঘামাচ্ছিলেন না। কারণ, দেশের কোথাও এতদিন ৫০০-র জাল নোট উদ্ধারের খবর ছিল না। এমনকী জাল নোটের জেলা মালদহতেও এতদিন পাঁচশো’র জাল নোট মেলেনি। মালদহ জেলা বণিকসভার সম্পাদক উজ্জ্বল সাহা হলফ করেই বলছিলেন, “৫০০ নিয়ে ভয় নেই। যত ভয় ২০০০-এর নোট নিয়েই।” কিন্তু এবার সেই গুড়েও বালি।
[ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের নাম করে ফোন, প্রতারকদের থেকে সাবধান]
নজরে ৫০০ টাকার নোট
মালদহের বৈষ্ণবনগর থানার পারদেওনাপুর-শোভাপুর সীমান্তের পাশেই ধুলিয়ান বাজার। মাঝখানে শুধু গঙ্গানদী। জলপথেই নৌকায় চেপে পারদেওনাপুর থেকে ধুলিয়ান যাতায়াত করেন দুই জেলার মানুষ। এই তো সেদিন ১৬ ডিসেম্বর। তখন রাত প্রায় ১১টা। ধুলিয়ান বাজার তখন শুনশান। শীতের রাতে টহলদারি পুলিশের নজরে পড়ে তিনজন যুবক। তারা সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করছে। ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? পুলিশের সন্দেহ হতেই তাড়া করে তাদের তিনজনকে ধরে ফেলে। তল্লাশি চালিয়ে তাদের ব্যাগ থেকে উদ্ধার হয় দু’বান্ডিল টাকা। সবই ৫০০ টাকার নোট। মোট এক লক্ষ টাকা। প্রথমে পুলিশও ৫০০-র নোটগুলিকে আসল নোট ভেবেছিল। কারণ পুলিশও জানত, পাঁচশোর কোনও জাল নোট হয় না। থানায় গিয়ে নোটগুলি ভালো করে পরখ করতে গিয়ে পুলিশ অফিসাররাও চমকে ওঠেন। পাঁচশো টাকার সব নোটই যে জাল নোট! ধৃতরাও জাল নোটের কথা স্বীকার করে নেয়। তারা পুলিশের জেরায় এও জানিয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে মালদহে ঢুকেছে নতুন ৫০০ টাকার নোটের জাল নোট। মালদহ থেকেই ওই এক লক্ষ টাকার জাল নোট নিয়ে তারা নদী টপকে ধুলিয়ান বাজারে আসে। তখনই পুলিশের জালে ধরা পড়ে যায়। এই প্রথম মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জ থানার পুলিশ উদ্ধার করেছে ৫০০ টাকার জাল নোট। এর আগে বারবার উদ্ধার হয়েছে দু’হাজার টাকার জাল নোট। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত আকবর আলি, আবু তাহের ও সাত্তার শেখ, তিনজনই পুরনো জাল নোটের পাণ্ডা। প্রথম দুজনের বাড়ি সুতি থানা এলাকায়। সাত্তারের বাড়ি ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জে। জালনোটগুলি বাংলাদেশ থেকে মালদহে আনা হয়েছিল বলে ধৃতরা স্বীকার করেছে। মালদহের বৈষ্ণবনগর সীমান্ত পেরিয়ে দু’হাজারি নোটের সঙ্গেই ওই জাল নোট ভারতীয় ভূখণ্ডে চোরা পথে ঢুকে পড়ে। তারপর পারদেওনাপুর হয়ে গঙ্গা নদী পেরিয়ে আসে ধুলিয়ান ফেরিঘাটে। ওই এক লক্ষ টাকা জাল নোট নিয়ে তারা কোথায় যাবে সেই প্ল্যান কষছিল। তখনই ধরা পড়ে যায়। সেই সঙ্গে ফাঁস হয়ে যায় ৫০০ টাকার জাল নোট পাচারের ঘটনা।
[সরকার পাঠাচ্ছে খাদ্যসামগ্রী, কোন চক্র উধাও করছে রেশনের চাল-গম?]
নোটবাতিলের উদ্দেশ্য প্রশ্নের মুখে
নোটবাতিলে যুক্তি দিতে গিয়ে নরেন্দ্র জানিয়েছিলেন এরপ ফলে জাল নোটের কারবারে লাগাম পরানো যাবে। তখন যেসব কারবারিরা জাল নোট করছিল তাদের কারবার বন্ধ ছিল মাত্র তিন মাস। অনেকেই ভেবেছিলেন, অন্তত কয়েক বছর আর দেখা মিলবে না নতুন ২০০০ ও ৫০০ টাকার জাল নোটের। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি মালদহের কালিয়াচক থানার সীমান্তবর্তী মজনুটোলা গ্রামে এক নাবালকের হাত থেকে একটি গোলাপি ২০০০ টাকার জালনোট উদ্ধার হয়। তারপর ৪ ফেব্রুয়ারি ২টি ২০০০ টাকার জাল নোট সমেত ধরা পড়েন কালিয়াচক-৩ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির কংগ্রেসের কর্মাধ্যক্ষ দিগম্বর মণ্ডল। এরপর জেলাজুড়েই একের পর এক জাল গোলাপি নোট উদ্ধারের ঘটনা সামনে আসছে। মালদহ জেলায় নতুন নোটের জাল নোট উদ্ধারের ঘটনার সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ৩৫টি। গ্রেপ্তার হয়েছে ৪২ জন পাচারকারী। প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার দু’হাজারি জাল নোট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে মালদহ জেলা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। তবে এই প্রথম সামসেরগঞ্জে মিলেছে ৫০০ টাকার নোট। যার পরিমাণ এক লক্ষ টাকা। আর এতেই আতঙ্কিত সব মহল। নগদে লেনদেন করার সময় এখন থেকে ৫০০-র নয়া নোটও পরখ করা ছাড়া যে আর উপায় নেই।
[পাচারের ছক বদল, অনলাইনে বিক্রি হাতির দাঁত-সাপের বিষ]
এক নজরে মালদহ জেলায় জাল নোট উদ্ধারের পরিসংখ্যানঃ
২০১১ – মোট উদ্ধার ৫৪,০০,০০০ টাকা, মামলা ৪১ টি, গ্রেপ্তার ৬৩ জন।
২০১২ – মোট উদ্ধার ১,১০,০০,০০০ টাকা, মামলা ১১৩ টি, গ্রেপ্তার ১৮৩ জন।
২০১৩ – মোট উদ্ধার ১,৪৫,০০,০০০ টাকা, মামলা ৭৯ টি, গ্রেপ্তার ১১১ জন।
২০১৪ – মোট উদ্ধার ১,৫২,০০,০০০ টাকা, মামলা ৮২ টি, গ্রেপ্তার ১২০ জন।
২০১৫ – মোট উদ্ধার ৩,০৯,০০,০০০ টাকা, মামলা ১০৫ টি, গ্রেপ্তার ১৪২ জন।
২০১৬ – মোট উদ্ধার ১,২৯,০০,০০০ টাকা, মামলা ৮০ টি, গ্রেপ্তার ১০৫ জন।
২০১৭ – মোট উদ্ধার ৪০,০০,০০০ টাকা, মামলা ৩৫ টি, গ্রেপ্তার ৪২ জন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.