সরোজ দরবার: বিকেলে ফিটন গাড়ি চেপে একটু বেড়িয়ে আসতে ভালবাসতেন তিনি। কিন্তু ব্রিটিশ প্রভুদের নিয়ম, সাহেবসুবোরা ছাড়া আর কেউ এ কাজ করতে পারবেন না। করলে মাথাপিছু হাজার টাকা ফাইন। তা একদিন যখন তিনি বেড়াতে বেরিয়েছেন তখন এক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা। তাঁর সাজপোশাক দেখে সাহেব প্রথমে তাঁকে স্বদেশীয়ই ভেবেছিলেন। কিন্তু ভুল ভাঙতেই রেগে অগ্নিশর্মা। ধার্য হল জরিমানা। কিন্তু কে ডরায় জরিমানাকে! সেদিন জরিমানা তো দিলেনই। কিন্তু জরিমানার ভয়ে কি বেড়ানো মাটি হবে! মোটেও না। তাই হাজার টাকা জরিমানা দিয়েই যেদিন ইচ্ছে করত সেদিন বেড়িয়ে আসতেন তিনি।
তিনি অ্যাঞ্জেলিনা ইওয়ার্ড। দেশ যাঁকে চেনে গওহরজান নামে।
গহওরজানের সুর-সংগীত-নৃত্য যেমন চর্চার বিষয়, তেমনই তাঁর জীবনও। আসলে বিড়ম্বিত ভাগ্যের মধ্যেও নিষ্ঠার জোরে কীভাবে নিজেকে সাফল্যের শিখরে তোলা যায়, তাঁর গোটা জীবন যেন তার পাঠ্যপুস্তক। এমনকী আজ যখন নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে হাজারো আলোচনা, শিল্পে-সাহিত্যে বারবার উঠে আসছে এই বিষয়, তখন তাঁর জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয় অত বছর আগে কোন পরিবেশের মধ্যে তিনি ক্ষমতায়নের কেন্দ্রবিন্দুটি টেনে নিয়েছিলেন নিজের দিকে। ‘দ্য ফার্স্ট ভয়েস অফ ইন্ডিয়া-গওহরজান’ নামে ডকু-ফিচারে কিংবদন্তি শিল্পীর সংগীত ও জীবনের এই দিকগুলিই আরও একবার সামনে তুলে ধরলেন পরিচালক চৈতালি রায়।
ছোটবেলায় জন্মদাতা বাবার ছেড়ে যাওয়া। পরে ধর্ম পরিবর্তন করে গওহর হয়ে ওঠা। দেশের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী মা-এর তত্বাবধানে সংগীত শিক্ষা। মায়ের হাত ধরেই ওয়াজেদ আলি শাহর দরবারে চলে আসা। শুরু নৃত্যশিক্ষা। যৌবনের প্রারম্ভেই আজকের দিনে যাকে বলে সেলেব্রিটি হয়ে ওঠা। সারা দেশ গওহরের রূপ ও সংগীতের সামনে যেন নুয়ে পড়েছে। আকুল তাবৎ রইস পুরুষকুল। অথচ একটিও সম্পর্ক টেকেনি তাঁর। যতবার ভালবেসেছেন ততবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। সম্পত্তি নিয়ে মামলায় জেরবার। এমনকী নিজের বাবাকেই টাকা দিতে হয়েছে পিতৃপরিচয়ের সাক্ষী দেওয়ার জন্য। আর এসবের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেশের প্রথম ‘রেকর্ডিং স্টার’। গ্রামোফোন কোম্পানি যখন প্রথমবার এ দেশে গান রেকর্ড করার কথা ভাবল, তখন অনেক নামী শিল্পীই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ছক ভেঙে সেদিন বেরিয়ে এসেছিলেন গওহরজানই। এ নিয়ে মৃদু বিতর্কের অবকাশ অবশ্য আছে। প্রথম গান রেকর্ডকারী শিল্পী হিসেবে উঠে আসে ব্যালটবালা শশীমুখীর নামও। তবে এ ডকু-ফিচারের পরিচালক অবশ্য জানাচ্ছেন, “যাঁদের নাম উঠে আসে তাঁদের কাছেও প্রস্তাব রাখা হয়েছিল, তবে প্রথম রেকর্ড করেছিলেন গওহরজানই।” শোনা যায় সেদিন রেকর্ডের জন্য ৩,০০০ টাকা নিয়েছিলেন গওহরজান।
কেন গহওরজানকে নিয়ে আস্ত একটা ডকু ফিচারের কথা ভাবলেন? “আমার মনে হয় আজ তো প্রযুক্তির উন্নতির ফলে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু সেদিন যখন এতকিছু ছিল না, তখন গহওরজান সংগীতে যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই বিষয়টি সকলের সামনে আসা উচিত। এখন অনেকের কাছেই তা অনেকটা অজানা। তাঁর এই ভাবনায় সহায়তা করেছেন সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন শুভদীপ সরকারও। এঁদের মিলিত প্রয়াসেই তৈরি হয়েছে ডকু-ফিচারটি। গবেষণার নিরিখে গওহরজানের জীবনের উপর যথেষ্ট আলো ফেলেছে সেটি। তবে অভিনয়ের দুর্বলতা কখনও সখনও রসভঙ্গ করেছে। সেক্ষেত্রে চিত্রনাট্যের পরিবর্তন ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে আরও একটু নজর দেওয়া দরকার ছিল বলে মনে হয়। তবে গওহর সুরের যে খোঁজ পরিচালক তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে এনেছেন তার জন্য সাধুবাদ দিতেই হয়। গওহরজানের গানগুলি এখানে যাঁর গলায় শোনা গেল সেই গার্গী ঘোষও রসিকজনের প্রশংসা পাবেন।
গওহর কথার অর্থ ‘মহার্ঘ’। আক্ষরিক অর্থেই তা যেন তাঁর ক্ষেত্রে সত্যি। তাঁর শিল্প যেমন মহার্ঘ, তেমন তাঁর জীবনও। “গওহরজানের মতো প্রগতিশীল একজন মানুষের কথা এবং তাঁর চরিত্রে যে প্রতিবাদী রূপ ছিল তা আজও আমাদের বিস্মিত করে।”, বলছিলেন পরিচালক। নিঃসন্দেহে তা সত্যি। এই ডকু-ফিচার যদি তরুণ প্রজন্মের কাছে গওহরজানের সংগীতকে পরিচিত করার পাশাপাশি তাঁর লড়াই, ছক ভেঙে বেরনোর মানসিকতাটিকেও চারিয়ে দিতে পারে, তবে তার থেকে ভাল আর কিছু হয় না। সেদিন প্রথম রেকর্ডের পর তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলে দিয়েছিলেন, ‘মাই নেম ইজ গওহরজান’। তাঁর বলিষ্ঠতার সিগনেচার যেন সেটাই। জীবন থেকে সংগীতকে আজও তিনি সমানভাবে আছন্ন করতে পারেন। এই ডলবি ডিজিটালের যুগেও গওহর সুর যেন এমন এক মদ, যার নেশা কোনওদিনই ফিকে হয় না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.