পুজোয় প্যান্ডেল হপিং করা হয়নি শামিমের। ইদে নূরদের বাড়িতে সিমুই খেতে যেতে পারেনি অমিত। রেড রোডে হাজার হাজার মানুষের আলিঙ্গনের চেনা ছবিটাও এবার দেখা যায়নি। বড়দিনে সবাই মিলে ব্যান্ডেল চার্চে গিয়ে হুল্লোড়টাও মিস। ধুর! উৎসবের আনন্দগুলো সব মাটি হয়ে গেল। অথচ, প্রতিবছর এই উৎসবগুলিতে কত না আনন্দ, কত না হই-হুল্লোড়, কত না খাওয়া দাওয়া, সর্বোপরি সম্প্রীতির এক অদ্ভুত মেলবন্ধন দেখা যায়। একটা আস্ত বছর কেটে গেল স্রেফ অজানা শত্রুর সাথে লড়তে লড়তে। শুধু কি উৎসব? আরও কত কিছুই তো মাটি হল। অপূর্ণ থেকে গেল অনেক আশা। অনেক লক্ষ্যই পূরণ হল না।করোনা না এলে কেমন হতে পারত ২০২০? খুঁজে দেখল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল।
বছর শুরুর আগে অর্থনীতি নিয়ে বহু আশা দেখিয়েছিল কেন্দ্র সরকার। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ (Nirmala Sitharaman) বড় মুখ করে ঘোষণা করেছিলেন, বছর শেষে ভারতকে অন্তত তিন ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করবেন। কিন্তু কোথায় কী? উলটে মহামারীর করাল গ্রাসে অর্থনীতির উপর নেমে এল মন্দার খাড়া। যা পরিস্থিতি তাতে বছর শেষে বেশ খানিকটা সংকুচিত হবে ভারতের জিডিপি (GDP)। অন্তত ৭.৫ শতাংশ। আর তিন ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির যে লক্ষ্যমাত্র অর্থমন্ত্রী ঠিক করেছিলেন, সেটা পিছিয়ে দিতে হবে অন্তত বছর দু’য়েক। কে জানে, করোনা না এলে হয়তো এবছরই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারত ভারত। হয়তো বেকারত্বের মার থেকেও মুক্তির রাস্তা খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু এই মহামারী সেই রাস্তা একেবারেই বন্ধ করে দিল।
করোনা যখন প্রথম আঘাত হানে, তখন এক ভয়াবহ অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মোকাবিলা করছিল দেশ। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিক্ষোভের জেরে মস্ত বড় দাঙ্গা সামলাতে হচ্ছিল রাজধানী দিল্লিকে। সেই সঙ্গে রাজধানীরই কেন্দ্রস্থলে শাহিনবাগে চলছিল সিএএ (CAA) বিরোধী অহিংস বিক্ষোভ। এই মহামারী যদি না আসত তাহলে গোটা বছরটাই হয়তো এই বিক্ষোভ-সিএএ নিয়ে জট সামলাতে হত কেন্দ্রকে। কিন্তু করোনার সুফলই বলা হোক, আর কুফলই বলা হোক, এর জেরে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এখনও পুরোদমে কার্যকর করতে পারেনি সরকার। স্তব্ধ করা গিয়েছে বিক্ষোভও।
এনপিআর (NPR) এবং এনআরসি (NRC)। করোনার জেরে এই দুটি বিষয়ে একেবারেই এগোতে পারেনি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। দেশের একটা বড় অংশের মধ্যে এই দুটি বিষয় নিয়ে আতঙ্ক থাকলেও আরেকটা বড় অংশ আবার এনআরসির অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। দুর্ভাগ্যবশত, তাঁদের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হতে চলেছে।
বছরভর লকডাউন আর কোয়ারেন্টাইনের আতঙ্কে মানুষ খেলাধুলো, কিংবা বিনোদনেই খুঁজে নিতে চেয়েছিল অবসর। কিন্তু সেটাও যেন এ বছর হওয়ার ছিল না। মহামারীর আতঙ্ক যেন খেলাধুলোর জগতেও এবছর তালা লাগিয়ে দিল। ফলে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টি-২০ বিশ্বকাপের ট্রফি যারা বিরাট কোহলির (Virat Kohli) হাতে দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁদের হতাশ হতে হল। যারা অবসরের পর প্রথমবার মহেন্দ্র সিং ধোনির ব্যাটিং স্টেডিয়ামে গিয়ে চাক্ষুস করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের ইচ্ছেও পুরণ হল না। পিছিয়ে দিতে হল ইউরো কাপ, কোপা আমেরিকা এবং সর্বোপরি অলিম্পিকের (Olympic) মতো মেগা স্পোর্টিং ইভেন্ট। কে বলতে পারে? করোনা না এলে হয়তো এবছরই কোহলির হাতে প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি, বা ধোনির ব্যাটে চেনা ছক্কা স্টেডিয়ামে বসেই দেখা যেত।
করোনাকালে বিড়ম্বনায় পড়েছিল বিনোদন জগতও। লকডাউনের (Lockdown) জেরে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল শুটিং।কাজ হারিয়ে অনেক শিল্পীকেই হাত পাততে হয়েছে অন্যের কাছে। অকালে মৃত্যু হয়েছে একাধিক ঐতিহ্যবাহী সিঙ্গল স্ক্রিনের। বিনোদুনিয়ায় কিঞ্চিত আশার আলো দেখিয়েছে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু এ ছবি অন্য হতে পারত। ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো’য়ের টিকিট পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি হয়তো এবারেও বাঁধত। অক্ষয়, আমির, সলমনদের ছবি নিয়ে বক্স অফিসে যুদ্ধ হত। এবারেও আয়ুষ্মান, রাজকুমার রাওদের মতো অভিনেতারা আলাদা করে নজরে পড়তে পারতেন। কিন্তু করোনার মারে কোনওটাই হল না।
এত দুঃসংবাদের মধ্যে অবশ্য সামান্য রুপোলি আলোও দেখিয়েছে এই ২০২০। আর সেটা পরিবেশের ক্ষেত্রে। বছর শুরুর আগে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছিলেন গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ভয়াবহ রুপ এবার সহ্য করতে হবে পৃথিবীকে। সব রেকর্ড ভাঙবে বিশ্বের তাপমাত্রা। দূষণ মাত্রা ছাড়াবে। কিন্তু টানা লকডাউনের জেরে সেই আশঙ্কা আর বাস্তবে পরিণত হয়নি। এত নিরাশার মধ্যে সেটাই যা আশার খবর ছিল।
বস্তুত, এই বিষের বছর আমাদের কাছ থেকে অনেক সম্ভাবনা কেড়ে নিয়েছে। বদলে আমাদের এমন কিছু মুহূর্ত উপহার দিয়েছে যা দেখে শিহরিত হতে হয়। যা দেখে আতঙ্কিত হতে হয়। সে স্টেশনে মায়ের মৃতদেহ আগলে রাখা শিশুই হোক, কিংবা খালি পায়ে সন্তানকে কোলে নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকা জননী। ক্লান্তিতে রেললাইনের উপর শুয়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেনে কাটা পড়া হোক, কিংবা একরত্তি মেয়ের মাইলের পর মাইল সাইকেল চালিয়ে বাবাকে নিয়ে ঘরে ফেরা, এই সব ছবি মানুষমাত্রকেই বেদনাদীর্ণ করতে বাধ্য। তাই বছর শেষে সকলের একটাই প্রার্থনা, পরিবেশটা নাহয় এমনই থাক, শুধু এই বিষের বিশ সাল যেন আর ফিরে না আসে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.