স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদাতা: এ যেন ঠিক কেঁচো খুঁড়তে কেউটে৷ বস্তাভর্তি গাঁজা সহ এক পাচারকারীকে হাজতে পুরেছিল বসিরহাট থানার পুলিশ৷ কিন্তু তাকে জেরা করে চক্ষু চড়কগাছ৷ এ তো ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’!
তবে স্রেফ ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ কথাটা বোধহয় মাটিয়া থেকে ধৃত আবদুল বাঁকি মণ্ডলের জন্য যথেষ্ট নয়৷ জঙ্গি-যোগ-সহ তার বায়োডাটায় অপরাধ জগত্ ও সন্ত্রাসের দুনিয়ার ‘মুক্তো’ ঝরে পড়ছে৷ একাধিকবার পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা লোকটি দেখতে নিরীহ হলেও আসলে গভীর জলের মাছ বলে মনে করছে পুলিশ৷ জঙ্গিদের এপার থেকে ওপার করার দায় ও তাদের সাময়িক নিরাপদ আস্তানা জোগাড়ের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে৷ সেই একই ব্যক্তি আবার আন্তর্জাতিক জাল নোট চক্রেও যুক্ত৷ শুধু কি তাই? পাক অধিকৃত কাশ্মীরে গিয়ে সেখানকার একাধিক জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ এবং প্রশিক্ষণ নেওয়া৷ আদতে জামাত-ই-ইসলামের সদস্য বাঁকি মণ্ডল কাশ্মীর থেকে ফিরে ‘আন্ডার কভার এজেন্ট’ হিসাবে কাজে নেমে পড়েছিল৷
এর আগে অযোধ্যায় হামলার সময় চার জঙ্গিকে বাংলাদেশ সীমান্ত পার করিয়ে ভারতে ঢুকিয়েছিল সে৷ তারাই এখান থেকে অযোধ্যা গিয়ে হামলা চালিয়েছিল৷ এবং সবচেয়ে বড় চমক যেন পুলিশের কাছে অপেক্ষা করছিল অন্য জায়গায়৷ বসিরহাটের আইসি দেবাশিস চক্রবর্তী জেরায় জানতে পারেন, এই মধ্যবয়সি যুবক পরিচিত বেলালের৷ কে এই বেলাল? কান্দাহার বিমান ছিনতাই মামলায় ১৫ বছর আগে এই বসিরহাট থেকেই তো ধরা পড়েছিল জলিল ওরফে বেলাল মিয়া৷ বাংলাদেশ থেকে এসে বেলাল ডেরা বেঁধেছিল এখানে শাঁকচূড়ায় এবং সেও তো বিমান অপহরণের আগে এক পাকিস্তানি জঙ্গিকে জলসীমান্ত দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ভারতে৷ সেও তো পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল এই শনিবার রাতে বসিরহাটের মাটিয়ায় ধৃত আবদুল বাঁকি মণ্ডলের মতোই৷ কোথাও যেন এক সরলরেখায় মিশে যাচ্ছে শাঁকচূড়া ও মাটিয়া৷ তা হলে কি এই এলাকায় মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনের স্লিপার সেল ছড়িয়ে রয়েছে?
আইসি দেবাশিস চক্রবর্তীর নেতৃত্বে পুলিশ অভিযান চালিয়ে যখন আবদুলকে ধরে তখন তাঁদের ধারণাতেও ছিল না জালে ঠিক কতবড় মাছ উঠেছে৷ জানা গেল যখন খবর এল ধৃতের বাড়ি গাছা গ্রামে৷ গাছা হল বসিরহাটের সেই গ্রাম যেখান থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত একেবারে যেন পাশের গাঁ৷ তারপর ধৃতের পুরনো ফাইল খুলে চোখ কপালে উঠল পুলিশের৷ দেখা গেল, এ তো যে-সে লোক নয়৷ এর কেস হিস্ট্রি লম্বা৷ সে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন হিজাবুল মুজাহিদিন ও জৈশ-ই-মহম্মদের ঘনিষ্ঠ৷ জঙ্গি সংগঠনের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর দীর্ঘদিন ভারতে একাধিক স্থানে এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছে৷ গাছা গ্রামে তার বাড়িতে সদ্য প্রয়াত হয়েছেন বাবা৷ দুই বিয়ে কিন্তু কোনও স্ত্রী থাকে না এখানে৷ সেও যে পাকাপাকি এখানে থাকত তা-ও তো নয়৷ বরং মাঝেমধ্যে আসত এবং কিছুদিন থেকেই উধাও হয়ে যেত৷ এখানে তার কাজ ছিল মূলত জঙ্গিদের সীমান্ত পার করিয়ে আনা ও আশ্রয় দেওয়া৷ গ্রামের বাসিন্দারা জানান, এখানে অনেকসময় বাইরের লোকজনের আনাগোনা চলত৷ অপরিচিত মুখের ভিড় দেখলেও তাঁরা কিছু বলতেন না৷ কেন না আবদুল তাদের বন্ধু বা আত্মীয় বলে পরিচয় দিত৷
এখন পুলিশ উদ্বিগ্ন এই ভেবে যে, কোন কোন সংগঠনের লোকজন আশ্রয় পেয়েছিল তার কাছে৷ তাদের মধ্যে কোথায় কারা ছড়িয়ে গিয়েছে৷ জেরা করে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানতে চায় পুলিশ৷ তবে সবকিছু ছাড়িয়ে দু’টি বিষয় বড় হয়ে উঠেছে৷ প্রথমত, সে যে হঠাত্ করে উধাও হয়ে যেত তখন তার গন্তব্য হত কোথায়৷ দ্বিতীয়ত, সে বেলালকে চিনল কী করে? বেলাল ধরা পড়েছে প্রায় ১৫ বছর আগে৷ কান্দাহর বিমান ছিনতাইয়ে যাদের ভূমিকা ছিল তাদের একজনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকা বেলালের হাত ধরেই কি তখন বছর ত্রিশের আবদুলের পাকিস্তান যাত্রা? বেলাল যখন গ্রেফতার হয় তখন গাছা গ্রামে নাকি বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে ছিল আবদুল? পুলিশের ধারণা, এই সমস্ত লিঙ্ক মেলানো গেলে ছবিটা পরিষ্কার হবে৷ মিলবে আরও কিছু সূত্র, যা ধরে হয়তো পৌঁছানো যাবে এই চক্রের গভীরে৷ চলছে সেই চেষ্টা৷
বসিরহাটের মাটিয়া থেকে আবদুল বাকি মণ্ডলকে ৩০ কেজি গাঁজা-সহ ধরেছিল পুলিশ৷ সে মালদা থেকে এই মাদক এনেছিল বলে খবর৷ তাই মালদাতেও সমান্তরাল তদন্ত শুরু হবে৷ ধৃতকে জেরা করে তারা জানতে পেরেছে, ২০০৩ সালে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে লস্কর-ই-তৈবা, জৈশ-ই-মহম্মদ ও হিজবুল মুজাহিদিনের মতো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে তার৷ ২০০৪ সালে সে আবার ভারতে ফিরে আসে৷ পুলিশি জেরায় সে জানিয়েছে, ওই সংগঠনগুলির থেকে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সরাসরি কোনও নাশকতা না ঘটাতে৷ বরং আন্ডার কভার এজেন্ট হয়ে সীমান্ত এলাকায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়৷ ২০০৪ থেকে ২০০৫ সালে তার সাহায্যেই বসিরহাট সীমান্তের চোরাপথ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিরা ঢুকত৷ তারপর বেশ কিছুদিন উধাও হয়ে গিয়েছিল সে৷ তার ভাই সাবির মণ্ডল অবশ্য দাদার বিষয়ে কিছু বলতে চাননি৷ সে জানায়, বাবা মারা গিয়েছেন কিছুদিন আগে৷ দাদা কী করত তা তিনি জানেন না৷
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে অযোধ্যায় জঙ্গি হামলার সময় চারজনকে বসিরহাট সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে সাহায্য করেছিল এই যুবকই৷ সীমান্ত পার হয়ে বসিরহাটের গাছা গ্রামে আব্দুল বাঁকি মণ্ডলের বাড়িতেই আশ্রয় নেয় তারা৷ বসিরহাট থেকে শিয়ালদহ স্টেশন এসে ট্রেনে করে দিল্লি যায় তারা৷ সেখান থেকে লখনউ হয়ে অযোধ্যায় গিয়ে হামলা চালায় তারা৷ এই ঘটনায় আব্দুল বাকি মণ্ডল-সহ চারজনকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ৷ তবে ২০১২ সালে হাই কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে বেপাত্তা হয়ে যায় সে৷ ২০১৩ সালে জাল নোট পাচারের অভিযোগে বসিরহাট সীমান্ত থেকে ফের গ্রেফতার হয় বাঁকি৷ কয়েকমাস জেলে থাকার আবার জামিন এবং একই ছকে তিন বছর নিখোঁজ৷ গোয়েন্দাদের ধারণা দু’বারই জামিন পাওয়ার পর পাকিস্তানেই গা ঢাকা দিয়েছিল সে৷ তবে বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার পর তার ফের বসিরহাট এলাকায় আসা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা৷ বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার পর কেন্দ্রের গোয়েন্দারা জানান, সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গিরা এদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে৷ এখন এটাই প্রশ্ন, ওপারের হামলাকারী জঙ্গিরা কি আবার বাঁকির সাহায্যে এদেশে ঢুকেছে? এদেশেও কোনও নাশকতার ছক কষছিল তারা? ধৃতকে এক দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেয় আদালত৷ সূত্রের খবর, তাকে জেরা করার জন্য বসিরহাটে আসবেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা৷ ধৃতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জঙ্গিদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যেতে পারে বলে আশা করছেন তদন্তকারীরা৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.