জীবন বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। এই স্রোতের টানেই হারিয়ে যায় মানুষ। ২০১৮ সালেও আমরা এভাবেই হারিয়েছি অনেক মানুষকে। যাঁদের শরীর আজ পঞ্চভূতে বিলীন। কিন্তু প্রতিভা অমর অক্ষয়। বছর শেষের মুখে তাঁদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের।
শ্রীবল্লভ ব্যাস
অভিনেতা হিসেবে হিরোর পর্যায়ে পৌঁছতে পারেননি। কিন্তু তাঁর অভিনয় দাগ কেটে গিয়েছিল দর্শকের মনে। তাই তো পার্শ্ব অভিনেতা হয়েও তিনি দর্শকের মধ্যে জনপ্রিয়। ‘লগান’, ‘সরফরোশ’, ‘দিল বোলে হাড়িপ্পা’, ‘মায়া মেমসাব’-এর মত বলিউডি ছবিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শ্রীবল্লভ ব্যাস। ৭ জানুয়ারি তিনি মারা যান।
আভা মুখোপাধ্যায়
১৫ জানুয়ারি প্রয়াত হন অভিনেত্রী আভা মুখোপাধ্যায়। বলিউডে তাঁর কেরিয়ার শুরু হয়েছিল চিত্রনাট্যকার হিসেবে। পরে ‘স্নিপ’, ‘দেবদাস’, ‘ডরনা জরুরি হ্যায়’, ‘ডিটেকটিভ নানি’-সহ একাধিক জনপ্রিয় সিনেমায় অভিনয় করতে দেখা যায় তাঁকে।
সুপ্রিয়া দেবী
প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালটা এবছর মোটেই সুখের হয়নি বাঙালি সমাজের। ২৬ জানুয়ারিই ভক্তদের চোখের জলে বিদায় নেন সুপ্রিয়া দেবী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫। বেণুদির প্রয়াণে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা চলচ্চিত্রজগত। শোকপ্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংস্কৃতি তথা রাজনৈতিক মহলের বহু ব্যক্তিত্ব।
শ্রীদেবী
তাঁর মৃত্যু চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ২৪ ফেব্রুয়ারি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুবাই গিয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে পর্যন্ত তিনি সবার সঙ্গে আনন্দও করেছেন। স্বামী বনি কাপুরের সঙ্গে ডিনারে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। তাই ফ্রেশ হতে বাথরুম গিয়েছিলেন। সেখানেই মৃত্যু হয় ‘রূপ কি রানি’-র। বাথটবে পাওয়া যায় তাঁর নিথর দেহ। শোকে পাথর হয়ে যায় সিনেজগত।
নার্গিস রবাদি (শাম্মী)
৬ মার্চ মারা যান বলিউডের অভিনেত্রী নার্গিস রবাদি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। বলিউডে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। সিনেমাজগতে শাম্মি আন্টি নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন।
স্টিফেন হকিং
মানুষ অমর নয়। মৃত্যু অবশ্যম্ভবী। প্রতি বছরই হানা দেয় যমরাজ। কিন্তু এবছরের শুরুতে যে মানুষটা মহাকাশে হারিয়ে গেলেন তিনি মহাকাশেরই মানুষ। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করেছেন আজীবন। ১৪ মার্চ, ৭৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং।
ললিতা চট্টোপাধ্যায়
৯ মে চলে গেলেন উত্তম জমানার আরও এক অভিনেত্রী। একসময় মহানায়কের সঙ্গে দাপিয়ে স্ক্রিনশেয়ার করা অভিনেত্রী ললিতা চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হলেন।উত্তম কুমারের ভক্ত ছিলেন ললিতাদেবী। সিনেমার জগতে আসাও মহানায়কের হাত ধরেই।তাঁর সঙ্গেই ‘বিভাস’ সিনেমার হাত ধরে শুরু হয়েছিল সে যাত্রা। তারপর ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘জয়জয়ন্তী’,‘মেমসাব’ থেকে ‘হার মানা হার’- কত মণিমুক্তই না রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। অভিনয় করেছেন ‘ভিক্টোরিয়া নম্বর ২০৩’, ‘তলাশ’, ‘আপ কি কসম’-এর মতো সিনেমায়।
রীতা ভাদুড়ি
নায়িকা হয়ে উঠতে না পারলেও পার্শ্বচরিত্রেই কামাল করে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী রীতা ভাদুড়ি। অভিনয়ের প্রতি এমন ভালবাসার জন্যই হয়তো কাজ থেকে অবসর নেওয়ার আগেই প্রয়াণ হল তাঁর। স্টার ভারত চ্যানেলের জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘নিমকি মুখিয়া’য় বর্তমানে অভিনয় করছিলেন তিনি। তার মাঝেই ১৭ জুলাই মৃত্যু হয় তাঁর। ২০টিরও বেশি সিরিয়ালে কাজ করেছেন রীতা ভাদুড়ি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সারাভাই ভার্সেস সারাভাই’, ‘আমানত’ এবং ‘কুমকুম’।
করুণানিধি
যে বয়সে মানুষ রাজনীতিতে ঢোকার চিন্তাভাবনা করে, সেই বয়সে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তবে প্রথম থেকেই রাজনীতি তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠেনি। দক্ষিণী ছবিতে চিত্রনাট্য লিখতেন তিনি। কিন্ত রাজনীতি থেকে কখনও বেরিয়ে আসেননি। রাজনীতিতে তাঁর কেরিয়ার শুরু হয় ডিএমকে দলের হাত ধরে। প্রায় দু’দশক তামিলনাড়ুর প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন তিনি। ৭ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়
মার্কসবাদে বিশ্বাসী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় যোগ দিয়েছিলেন বামপন্থী রাজনীতিতে। নিজের ক্ষমতায় জ্যোতি বসুর অত্যন্ত স্নেহভাজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আটের দশকে লোকসভা ভোটে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সিপিএম প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন তিনি৷ লোকসভায় স্পিকারও নির্বাচিত হন। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে মনেপ্রাণে বামপন্থী এই রাজনীতিবাদকেই ছাড়তে হয়েছিল রাজনীতির পথ। দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাঁকে। তীব্র অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তিনিও। শেষপর্যন্ত সব অভিমান মুছে গিয়েছিল ১৩ আগস্ট।
অজিত ওয়াড়েকর
স্বাধীনতা দিবসের রাতে খবরটা আসে অপ্রত্যাশিতভাবেই। প্রয়াত প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক অজিত ওয়াড়েকর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ জিতে বিশ্ব ক্রিকেটের মানচিত্রে ভারতের নাম উজ্জ্বল হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। শুধু তাই নয়, ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে দলেরও সদস্য ছিলেন। দীর্ঘরোগ ভোগে ৭৭ বছর বয়সে বিদায় নেন তিনি।
অটলবিহারী বাজপেয়ী
দেহ তাঁর অনেকদিন আগেই জবাব দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বোধহয় অনুরাগীদের নাড়ির টান ছিন্ন করে যেতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ১৬ আগস্টের পর আর বাঁধ মানল না আবেগ। চিরতরে চলে গেলেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা ভারতরত্ন অটলবিহারী বাজপেয়ী। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর দল বিজেপি তো বটেই, গোটা দেশে নেমে আসে শোকের ছায়া।
আয়ুব বাচ্চু
১৮ অক্টোবর সকাল ৯টা। নিজের বাড়িতে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রবাদপ্রতীম সংগীতশিল্পী আয়ুব বাচ্চু৷ অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন৷ বাংলাদেশে রক মিউজিককে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। তাঁর রক গান বাংলাকে নতুন এক দিশা দেখিয়েছিল।
অনন্ত কুমার
দীর্ঘদিন ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন অনন্ত কুমার। বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাও চলছিল৷ কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ১২ নভেম্বর মারা যান তিনি। সাতের দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন, তখন তার বিরোধিতার করায় জেলও যেতে হয়েছিল তাঁকে৷ ২০১৪ সালে দিল্লিতে বিজেপি সরকার গড়ার পর তাঁকে সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রকের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷
স্ট্যান লি
দ্য ফ্যান্টাস্টিক ফোর, আয়রন ম্যান, দ্য ইনক্রেডিবল হাল্কের মতো ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্ররা আজ পর্দা কাঁপায়। এদের সবাইকে সৃষ্টি করেছিলেন স্ট্যান লি। ১৩ নভেম্বর ৯৫ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি। কল্পনাকে ডান মেলে উড়তে শিখিয়েছিলেন স্ট্যান লি। তবে সেই কল্পনা কিন্তু শুধু বিদেশি সুপারহিরোদের মধ্যেই সীমিত ছিল না। ভারতের জন্যও তিনি বানিয়ে দিয়েছিলেন একটি সুপারহিরো। নাম ‘চক্র’।
জর্জ বুশ (সিনিয়র)
৩০ নভেম্বর প্রয়াত হন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ হারবার্ট ওয়াকার বুশ৷ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা নাশ করে তাঁর আমলেই পতন হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের৷ সিনিয়র বুশের আমলেই চিনে ঘটে তিয়েনআনমেন স্কোয়্যার গণহত্যা৷ তাঁর আমলে তেল তোলা নিয়ে বিবাদের জেরে কুয়েত আক্রমণ করে ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হুসেন৷ তারপরই সিনিয়র বুশের নির্দেশে শুরু হয় অপারেশন ‘ডেজার্ট স্টর্ম’৷
বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী
৩০ নভেম্বর প্রয়াত হন অভিনেতা তথা নাট্যকার বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী৷ ঢাকুরিয়ার বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর৷ দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি৷নাটকের মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, অভিনয় জগতের সমস্ত স্তরেই দাপিয়ে কাজ করেছেন বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী৷ সমস্ত ক্ষেত্রেই তাঁর ছিল অবাধ যাতায়াত৷ বহু নাটকে কাজ করেছেন অভিনেতা তথা নাট্যকার উৎপল দত্ত এবং শম্ভু মিত্রের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও৷
গৌতম দে
বাংলা টেলিভিশন জগতে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় মুখ। বহু বছর ধরে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গৌতম দে। ভিন্ন চরিত্রে তাঁর অভিনয় মন ছুঁয়েছিল দর্শকদের। তবে তাঁকে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল টেলিভিশন। ‘জন্মভূমি’ ধারাবাহিক থেকে শুরু হয়েছিল জয়যাত্রা। এরপর ‘তিথির অতিথি’, ‘এ কোন সকাল’, ‘লাবণ্যের সংসার’, ‘ধ্যাত্ তেরিকা’, ‘ইস্টিকুটুম’, ‘কুসুমদোলা’র মতো জনপ্রিয় সিরিয়ালে দেখা গিয়েছে তাঁকে। সম্প্রতি ‘রানি রাসমণি’ ধারাবাহিকেও অভিনয় করছিলেন তিনি। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ডিসেম্বর বেসরকারি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়
গায়ক হিসেবে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে জনপ্রিয়তা দেয় ‘জাগো দুর্গা’। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র এই গানটিই বিখ্যাত করে তাঁকে। ছয়ের দশকে একাধিক ছবিতেও রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন তিনি। চল্লিশের শেষের দিকে একসঙ্গে অনেক গানও উপহার দিয়েছেন তিনি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রেখো মা দেশেরে মনে’, ‘একদিন ফিরে যাব চলে’।
নিরুপম সেন
২০০১ সালে যখন মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে জ্যোতি বসু অবসর নেন, তখনই পোড়খাওয়া এই রাজনীতিবিদকে মন্ত্রিসভায় শামিল করার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। দলের নির্দেশে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোটে জেতেন এবং শিল্পমন্ত্রী হন। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি। সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো কারখানা ও নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ২৪ ডিসেম্বর প্রয়াত হন প্রাক্তন এই মন্ত্রী।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
আশ্চর্য সমাপতন! একসময় তিনিই লিখেছিলেন ‘কলকাতার যিশু’। আর যিশুর জন্মদিনেই ইহলোক ত্যাগ করলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘শুধু কবিতার জন্য আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।’ আর নীরেন্দ্রনাথ শিখিয়েছিলেন কীভাবে কবিতাকে ভালবাসতে হয়। তাই তো তাঁর সময় থেকে বর্তমান কালের তরুণ কবি, সবার কাছেই তিনি আরাধ্য। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগার পর ৯৪ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন তিনি।
মৃণাল সেন
সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক। একসময়ে একই সঙ্গে উচ্চারিত হত এই তিন দিকপাল পরিচালকের নাম। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। তিনিও আর ছবি বানাতেন না। বহুকাল বার্ধক্যজনিত অসুখে শয্যাশায়ী ছিলেন। ৩০ ডিসেম্বর প্রয়াত হলেন পরিচালক মৃণাল সেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.