গৌতম ভট্টাচার্য: রাহুল দ্রাবিড়ের ভাগ্যই বোধহয় এ রকম। তাঁর চূড়ান্ত সুখের মুহূর্ত তৈরি হতে হতে হঠাৎ করে কালো মেঘ মাথার ওপর দাঁড়িয়ে যায়। কে জানত অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপ জয়ও যে ব্যতিক্রম হবে না?
নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়া অপরাজিত সেঞ্চুরিতে যিনি কোচ দ্রাবিড়ের মাথাতে বিশ্বজয়ীর তাজ বসিয়ে দিয়েছেন সেই মনজ্যোৎ কালরা-র অনূর্ধ্ব উনিশ খেলার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ক্রিকেটমহলের একাংশ তো নিশ্চয়ই। খোলাখুলি দাঁড়িয়ে গিয়েছেন দুই প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার- বিষেণ সিং বেদী ও কীর্তি আজাদ। পরিষ্কারভাবে এঁরা বলছেন যে কালরা বয়স ভাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ খেলেছেন। তাঁর আসল বয়স কুড়ি বছরেরও বেশি। ভারতীয় বোর্ড মঙ্গলবার রাতের দিকে সংবাদ প্রতিদিন-কে জানাল কীর্তি আজাদ তাদের অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু সেই অভিযোগের বৈধতা তারা খুঁজে পায়নি। বেদীর কাছে যা একেবারেই বিস্ময়কর নয়।
[ বিশ্বজয়ীর ঘরে ফেরা, ঈশানের মুখে শুধু স্যার দ্রাবিড়ের কথা ]
“আমি আর কী বলব। বিশ্বকাপ জেতার আনন্দে সবাই এত ডগমগ যে সেই পরিবেশটা ভাঙতেও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সত্যি কথা হল এই যে আমি জম্মু কাশ্মীরের কোচ থাকাকালীন আন্ডার ফোরটিন লেভেলে এই ছেলেটির বিরুদ্ধে কমপ্লেন করেছিলাম। তখন ওর বয়স ছিল ষোলো। কেউ কিছু করেনি। আজও কিছুই হবে না,” মঙ্গলবার দিল্লি থেকে বললেন বিষেণ সিং বেদী। আরেকজন ভারতীয় প্রাক্তন ক্রিকেটার আরওই চাঁচাছোলা। তিনি কীর্তি আজাদ। তিরাশির বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম সদস্য এবং সাংসদ। “মনজ্যোৎ কালরার দুটো বার্থ সার্টিফিকেট রয়েছে। একটা নকল। একটা আসল। নকলটা দিয়ে ও আন্ডার নাইনটিন ওয়ার্ল্ড কাপটা খেলল,”এ দিন সংবাদ প্রতিদিন-কে ফোনে বললেন কীর্তি।
বেদী বিশ্বকাপ জেতার হাওয়ায় বিতর্ক চাইছেন না। বলছেন, “কী দরকার? কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে।” পরক্ষণেই আত্মসমালোচনার ঢংয়ে বলছেন, “শুধু তো আমরা নই। গোটা উপমহাদেশ এই একটা রোগে ছেয়ে গেছে। বয়স ভাঁড়ানো। সবাই বয়স ভাঁড়াচ্ছে এজ গ্রুপ ক্রিকেটে,”বলেই আবার তিনি হয়ে পড়ছেন অরিজিনাল বেদী। “রাহুল দ্রাবিড় থাকতে কেন এ জিনিস ঘটবে? রাহুল নিজে পতৌডি মেমোরিয়াল লেকচারে এসে বলল, বয়স ভাঁড়ানো আমাদের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় রোগ। অথচ সে নিজের টিমকেই ছেঁকে দেখে নিল না?” বেঙ্গালুরুতে দ্রাবিড়ের সমর্থকরা বলছেন, এটা রাহুলকে অন্যায় দোষারোপ করা হচ্ছে। কোচ কি বার্থ সার্টিফিকেট খতিয়ে দেখবে নাকি? সেটা কি তার কাজ? আন্ডার নাইনটিন ক্রিকেটে কে এলিজিবল কে এলিজিবল নয়, সেটা তো ঠিক করবে বোর্ড। তাদের নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। আন্ডার সেভেনটিন পর্যায় থেকে সেই টেস্ট চালু হয়। বোন স্ক্যান টেস্ট। হাসপাতাল থেকে তার সার্টিফিকেট আনতে হয়। ধরে নেওয়া হয় বয়সের ক্ষেত্রে অব্যর্থ রায় একমাত্র ফরেন্সিক মেডিক্যাল সায়েন্সই দিতে পারে।
[ আসন্ন বিশ্বকাপে সিনিয়রদের দলে পৃথ্বীদের দেখতে চান না দ্রাবিড় ]
সমস্যা হল অনেক হাসপাতাল রয়েছে যাদের দিয়ে খুদে ক্রিকেটারদের অভিভাবকেরা জাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে আনেন। মুম্বই থেকে ভারতের জুনিয়র ক্রিকেটের সঙ্গে পর্যবেক্ষক হিসেবে তিরিশ বছর যুক্ত থাকা জনৈক মুখপাত্র বলছিলেন, এটা এমন অসুখ যেখানে ক্রিকেটারের চেয়েও বেশি করে যুক্ত থাকে হয় অভিভাবক নয় স্কু্ল নয় কোচেরা। তারাই আন্ডার সেভেন্টিন থেকে বয়স কমায় আর সেই বয়সটাই চলতে থাকে।
কীর্তি বলছিলেন, “মনজ্যোৎ কালরার যে দুটো আলাদা বার্থ সার্টিফিকেট রয়েছে তার কপি আমরা দিল্লি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে দাখিল করেছিলাম গত বছর। কোনও কাজ হয়নি। আমি নিজে দিল্লি পুলিশে গিয়ে কমপ্লেন করেছি। অফিশিয়াল এফআইআর করেছি। মাইন্ড ইট আমি একজন এমপি। তবু ওরা কোনও কথা শোনেনি।” ক্রিকেটসংস্থা না হয় বিভিন্ন কারণে ব্যবস্থা না নিতে পারে। তাদের স্বার্থ থাকতে পারে। দিল্লি পুলিশের কী স্বার্থ? কীর্তির দাবি কিছু পুলিশ অফিসারের ছেলেও বয়স ভাঁড়িয়ে এজ গ্রুপ টুর্নামেন্ট খেলে। তাই এটা একটা বিশাল বড় র্যাকেট হয়ে গিয়েছে। যেখানে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই হয়ে যায় বিচারপতি।
মনজ্যোৎ কালরার নির্বাচন নিয়ে বয়সভিত্তিক বিতর্ক গত বছর সেপ্টেম্বর মাসেও প্রচুর হয়েছে। দিল্লির অনূর্ধ্ব ১৯ টিমের তিনি ক্যাপ্টেন বলে লাইমলাইট আরও বেশি করে তাঁর ওপর। তাঁর প্যান কার্ডও নাকি দুটো। একটায় দেখাচ্ছে জন্ম ১৯৯৮—তে। অন্যটায় জন্ম ১৯৯৯—তে। দ্বিতীয় প্যান কার্ডের সুবাদে তিনি অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপ খেলেন। ডিডিসিএ—র মুখ্য প্রকাশক বিচারপতি বিক্রমজিৎ সেন তখন কালরাকে নির্দেশ দেন, আবার তাঁকে বয়স নির্ধারক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। ভারতীয় বোর্ড তার আগেই জানিয়ে দিয়েছিল যে একটি প্যান কার্ডে কালরার দেওয়া ১৯৯৯ সাল জাত এই সার্টিফিকেটই তারা প্রামাণ্য ধরছে। কিছু অভিভাবক তখনও দিল্লি ক্রিকেট সংস্থায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন যে এজ গ্রুপ ক্রিকেটে তাদের ছেলেরা কালরার সঙ্গে পড়েছে। তারা জানে বয়সটা যে একবছর কমানো আছে। নতুন করে বোন এক্সরে—র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কালরা টিমে ঢোকেন। কীর্তিরা সেই পরীক্ষার ফল মানতে রাজি নন।
[ পৃথ্বীদের বিশ্বজয়ী হওয়ার কারণ ফাঁস করলেন খোদ শচীন ]
ভারতীয় বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হলে যুগ্ম সচিব অমিতাভ চৌধুরীকে ধরা যায়নি। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের ফাইনালে যিনি টিমের সঙ্গে ছিলেন সেই রত্নাকর শেট্টি অভিযোগের জবাব দিলেন। “এটা ঠিক মনজ্যোৎ কালরার বিরুদ্ধে আমরা লিখিত অভিযোগ পাই। সেটা বছর দুই আগে কীর্তি আজাদ পাঠিয়েছিল। আমরা তখন মনজ্যোতের কাগজপত্র খতিয়ে দেখি। ওর বোন টেস্টের রিপোর্টও ঠিক ছিল। কাজেই বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী ওর খেলা আটকায়নি,’’ সংবাদ প্রতিদিনকে বলেন শেট্টি। কিন্তু এই যে বলা হচ্ছে মনজ্যোতের দুটো প্যান কার্ড, দুটো পাসপোর্ট, দুটো বার্থ সার্টিফিকেট? শেট্টি আরও বলেন, “কীর্তি আজাদ তো সে সব আমাদের দেয়নি। শুধু লেখে যে ও সংশ্লিষ্ট প্লেয়ারের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে। কিন্তু শুধু এফআইআরের ভিত্তিতে কী করে ব্যবস্থা নিই। কী করেই বা খেলা আটকাই।” ক্রিকেটমহলে কালরা সমর্থকরা বলছেন, ঈর্ষাকাতর কিছু অভিভাবকেরা কালরার পিছনে লেগেছেন। আবার বেদীর কথা শুনলে মনে হবে সেটা ভিত্তিহীন। কারণ তিনি তো আন্ডার ফোর্টিন লেভেলেই বিপক্ষ টিমের কোচ হিসেবে বয়স ভাঁড়ানোর অভিযোগ এনেছিলেন। সুতরাং অভিযোগের ডালা নতুন নয়, চার-পাঁচ বছর ধরেই খোলা রয়েছে।
দিল্লি থেকে কালরা সমর্থকরা বলছেন, বয়স ভাঁড়ানোর অভিযোগ না এনে বরং সেলিব্রেট করা উচিত মনজ্যোতের সাফল্য। নিজের বিরুদ্ধে উড়তে থাকা টানা অভিযোগকে যে ফুৎকারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ফাইনালের সেঞ্চুরিতে। দেশকে বিশ্বকাপ দিয়েছে। এখানে আবার বেদী এসে পড়েছেন। শঠতা এসে গেলে আবার কীসের ক্রিকেট। কীসের ট্রফি। ক্রিকেটমহলে এমনও শোনা যাচ্ছে যে, মনজ্যোতের দুটো বার্থ সার্টিফিকেট কপি করে আইসিসির কাছে পাঠানো হচ্ছে। কপি মার্ক করা হচ্ছে রানার আপ ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কাছে। কেউ কেউ বলছেন মনজ্যোতের নাকি দুটো পাসপোর্ট, যা সত্যি হলে চাঞ্চল্যকর। আইসিসির নিয়মানুযায়ী কোনও টিম বেশি বয়সি প্লেয়ার খেলালে তাদের চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা বাতিল হয়ে যায়। আইসিসি ভারতকে চটাবে বলে কেউ মনে করে না। কিন্তু একটা বিতর্কের কালো মেঘ তো উঠবেই।
সেই দ্রাবিড়ীয় ভাগ্য?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.