তেলের দেশে ঝড় উঠেছে। সেই ঝড়ের নাম ফুটবল। ইউরোপীয় ফুটবলের জনপ্রিয়তাকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে সৌদি প্রো লিগ আপাতত সবার চর্চায়। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, করিম বেঞ্জিমা, নেইমার, সাদিও মানের মতো সুপারস্টারদের নিয়ে ফুটবলবিশ্বে বিপ্লব এনেছে সৌদি আরবের ফুটবল লিগ। দুনিয়া কাঁপানো এই লিগেই ভারতীয় কানেকশন হিসেবে হাজির থাকছেন এলকো শ্যাটরি (Eelco Schattorie)। কলকাতার ইউনাইটেড স্পোর্টস, ইস্টবেঙ্গল, কেরল ব্লাস্টার্স এবং নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেডের প্রাক্তন বস এলকো আল এত্তিফাকের টিডি হিসাবে কাজ করছেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন তারকা স্টিভেন জেরার্ডের সঙ্গে। সৌদি আরবের বহুল চর্চিত লিগ, আল এত্তিফাক এবং ভারতীয় ফুটবল নিয়ে দাম্মাম থেকে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে সাক্ষাৎকার দিলেন এলকো। শুনলেন কৃশানু মজুমদার।
সৌদি প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে এই মুহূর্তে চর্চা সব থেকে বেশি। বিশ্বসেরা সব তারকারা খেলতে আসছেন সৌদি আরবে। আপনি খুব কাছ থেকে দেখছেন এই লিগ। অতীতেও কাজ করেছেন এখানে। বিদেশি তারকাদের এত ভিড় কেন সৌদি প্রিমিয়ার লিগে?
এলকো: সৌদি প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে গোড়ার দিকের ইন্ডিয়ান সুপার লিগের তুলনা করা যেতে পারে। দুই দেশের দুই লিগের মধ্যে মূলগত পার্থক্য রয়েছে। শুরুর দিকে আইএসএলে বিশ্বফুটবলের বিশ্বখ্যাত সব তারকাদের আনাগোনা ছি্ল। নিজেদের সেরা সময় ফেলে আসা তারকারা খুব বেশি ম্যাচ খেলেননি আইএসএলে। তাঁদের উপস্থিতিটাই ছিল আইএসএলের জন্য অনেক বড় বিজ্ঞাপন। দেল পিয়েরো, রবার্তো কার্লোসের মতো তারকা নেমেছেন ইন্ডিয়ান সুপার লিগে। কিন্তু সৌদি লিগে যারা খেলতে আসছে, তারা এখনও খেলে চলেছে। অবসর নেয়নি, চোটগ্রস্তও নয়। লিগটার গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য, তার মানোন্নয়নের জন্য সৌদি আরবে আনা হচ্ছে বিশ্ববন্দিত সব তারকা ফুটবলারদের। বিশ্বের অন্যতম সেরা লিগ করাই উদ্দেশ্য। কিন্তু শুধু বিদেশি তারকাদের আনলেই তো হবে না। স্থানীয় ফুটবলার তুলে আনতে হবে। বিদেশ থেকে কেবল প্লেয়ার এনে একটা লিগকে সেরার সেরা করা সম্ভব নয়। দেশীয় ফুটবলের উন্নতিও দরকার। সৌদি লিগে একেকটা দল আট জন করে বিদেশি ফুটবলার সই করাতে পারে। এই পরিসংখ্যান থেকেই বুঝতে পারছেন, প্রথম একাদশে স্থানীয় ফুটবলারের সংখ্যা যথেষ্ট কম। বিদেশি ফুটবলারের ঢক্কানিনাদ। বিদেশি প্লেয়ার এনে লিগের গুণমান বাড়ানোর সুবিধা হল, লিগের নাম ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র, শক্তিশালীও হবে লিগ, মানও বাড়বে। কিন্তু প্রশ্ন যে থেকেই যাচ্ছে। এর ফলে সৌদি ফুটবলের মান কি আদৌ বাড়বে? গোড়ার দিকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ছবিটাও একই রকম ছিল। সেই কারণে ইংল্যান্ড বড় টুর্নামেন্টে ভাল রেজাল্ট পাচ্ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি এখন বদলেছে। সৌদি আরবের ফুটবল কতটা উন্নতি করে, তা বলবে সময়।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো ইউরোপ থেকে আগেই চলে এসেছেন সৌদি আরবে। নেইমার এলেন আল হিলাল ক্লাবে। করিম বেঞ্জিমাও এসে পড়েছেন সৌদি প্রিমিয়ার লিগে। লিওনেল মেসির নতুন ঠিকানা ইন্টার মায়ামি। ইউরোপের ফুটবল থেকে একে একে খসে পড়ছে অলঙ্কার। আপনার কি মনে হয় ইউরোপের ফুটবল তার গৌরব হারাবে?
এলকো: ইউরোপিয়ান লিগ তার গৌরব কখনওই হারাবে না। রোনাল্ডো-নেইমার-বেঞ্জিমার মতো বিদেশি তারকারা এখন সৌদি আরবে খেলছে। লিওনেল মেসি চলে গিয়েছে ইন্টার মায়ামিতে। সবই ঠিক। ইউরোপের ফুটবল তারকা হারালেও সার্বিক ভাবে ফুটবল সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে না। এখনও ইউরোপের ফুটবল নিয়ে মিডিয়ায় দারুণ আগ্রহ। এখনও ক্লাবগুলোর পরিকাঠামো বেশ ভাল। গ্রাস রুট থেকে প্রথম দল, পরিকাঠামোর দিক থেকে অন্যান্য মহাদেশের ফুটবলকে টেক্কা দেবে ইউরোপ। ফলে সব দিক বিবেচনা করেই বলছি, রোনাল্ডো-নেইমারের মতো তারকা অন্য মহাদেশে চলে এলেও ইউরোপের লিগ এতটুকুও গৌরব হারাবে না, নষ্ট হবে না সুনাম।
আপনি আল এত্তিফাক ক্লাবের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ফুটবলার স্টিভেন জেরার্ড কোচ। আপনি সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন তাঁর। জেরার্ডকে কোচ হিসেবে বেছে নিলেন কেন?
এলকো: ঠিকই।স্টিভেন জেরার্ডের ইন্টারভিউ আমিই নিয়েছি। শুধু জেরার্ড নন, আরও দু’ জন নামী কোচের ইন্টারভিউও আমাকেই নিতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত জেরার্ডকে নেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি কারণের জন্য। জেরার্ডের প্রেজেন্টেশন বেশ ভাল লেগেছে। ওঁর ফুটবলের মতোই স্মার্ট। জেরার্ড দুর্দান্ত সব প্রফেশনাল স্টাফ এনেছে। জেরার্ড এবং তাঁর পেশাদার কোচিং স্টাফ আমাদের ক্লাবকে সাহায্য করবে বলেই আমার বিশ্বাস। শুধু আমার ক্লাব আল এত্তিফাক নয়, সৌদি আরবের বেশিরভাগ ক্লাবই এখন বড় নামের পিছনে ছুটছে। তার একটাই কারণ, লিগটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শীর্ষে তুলতে হবে। আর বিদেশ থেকে বিখ্যাত সব তারকারা অর্থের জন্যই এখানে আসছে। অর্থ অবশ্যই বড় ফ্যাক্টর।
কলকাতায় ইউনাইটেড স্পোর্টস, ইস্টবেঙ্গলের পরে ইন্ডিয়ান সুপার লিগেও কোচিং করিয়েছেন আপনি। ভারত থেকে সৌদি আরব, এই ফুটবল পরিক্রমা নিয়ে বলুন।
এলকো: আইএসএলে কাজ করে তারপরে সৌদি আরবে এসেছি এমন নয়। অতীতেও মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করেছি। আল এত্তিফাকের টিডি হিসেবে এখন আমি কাজ করছি বটে। তবে হেড কোচ হিসেবে ফেরাই আমার লক্ষ্য। আইএসএলের কোনও ক্লাব আগামিদিনে ভাল প্রস্তাব দিলে আমি আবার ফিরতেই পারি ভারতে। আগে অবশ্য দেখে নেব সংশ্লিষ্ট ক্লাবের পরিকাঠামো এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা কেমন। ভারতে কোচিং করার সময়ে শুনেছি, আমি উদ্ধত, আমি অহংকারী। আমি আসলে স্পষ্টবক্তা। সেই কারণেই আমাকে অনেকেই পছন্দ করেন না। এদিকে সৌদি আরবে ফিরে আসার জন্য আল এত্তিফাক আমাকে ছ’ বারের বেশি অনুরোধ করেছে। অতীতেও আল এত্তিফাকের বয়সভিত্তিক দলের সঙ্গে কাজ করেছি। এতবার করে আমাকে ফিরে আসার জন্য অনুরোধের অর্থ হল, অতীতে নিশ্চয় আমি ভাল কিছু করেছি।
আপনাদের টিম সম্পর্কে বলুন। এই মুহূর্তে আপনার দল সৌদি প্রিমিয়ার লিগে দু’ নম্বরে। যদিও লিগ সবে শুরু। যে কোনও মুহূর্তে অবস্থান বদলে যেতে পারে। রোনাল্ডো-নেইমার-বেঞ্জিমার দলের বিরুদ্ধে নামতে হবে। কঠিন পরীক্ষায় কিন্তু বসতে হবে।
এলকো: আমাদের টিম গত বছর খুব একটা ভাল হয়নি। দলের ভারসাম্য নড়ে গিয়েছিল। এবার যে পরিমাণ অর্থ আমাদের হাতে রয়েছে, তা দিয়ে ফ্রান্সের তারকা মুসা ডেম্বেলে, লিভারপুলে খেলা জর্ডন হেন্ডারসন, জ্যাক হেনড্রির মতো স্কটিশ ফুটবলার নেওয়া হয়েছে। আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলব। নতুন ট্রান্সফার উইন্ডোতে নেওয়া হবে কয়েকজন প্লেয়ার। শুধু বিদেশি নয়, স্থানীয় ফুটবলারও সই করাবো। এবার চ্যাম্পিয়ন হয়তো হতে পারবো না। তবে সেরা চারের মধ্যে থাকাটাই আমাদের লক্ষ্য।
আপনি ভারতেও কোচিং করিয়েছেন। এখন রয়েছেন সৌদি আরবে। দুই দেশের ফুটবল সম্পর্কে কী বলবেন?
এলকো: ভারত ও সৌদি আরবের ফুটবলের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আইএসএলের থেকে অনেক শক্তিশালী সৌদি প্রো লিগ। সার্বিকভাবে পরিকাঠামোও বেশ ভাল। কলকাতা, কেরল ব্লাস্টার্স, নর্থ-ইস্টে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রতিভার অভাব নেই ভারতে। কিন্তু একটা পর্যায়ের পরে আর এগোচ্ছে না ভারতীয় ফুটবল। উন্নতির এখনও অনেক জায়গা রয়েছে। শেষ করার আগে বলি, আল এত্তিফাকে আমি টিডি হিসেবে এখন কাজ করছি। তবে কোচ হিসেবে কাজ করাই আমার লক্ষ্য। এখন যে কাজটা করছি, তা খুব ইন্টারেস্টিং। নতুন এক জার্নি, নতুন চ্যালেঞ্জ। আমি উপভোগ করছি আমার কাজ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.