দুলাল দে: তথ্য বলছে, শুধু টানা ৮টা ম্যাচে গোল না খাওয়াই নয়। কোচ ইগর স্টিমাচের (Igor Stimac) হাতে সাফল্যর পরিসংখ্যান রীতিমতো ঈর্ষণীয়। ক্রোয়েশিয়ার জাতীয় দলের এক নম্বর ডিফেন্ডার হিসেবে বিশ্বকাপে খেলেছেন বলেই কি স্টিমাচের হাতে ভারতীয় দলের ডিফেন্স এতটাই সুরক্ষিত?
হয়তো অনেকেই ভুলে গিয়েছেন। তাহলে আরও একবার ইউটিউবে গিয়ে ’৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচটা দেখে নিন। সেদিন ফ্রান্সের কাছে ক্রোয়েশিয়া ম্যাচটা ১-২ গোলে হারলেও, জিনেদিন জিদানকে ডিফেন্সে নড়াচড়া করতে দেননি আমাদের এই ভারতীয় দলের কোচ স্টিমাচ। ফলে তাঁর হাতে পড়ে সন্দেশ ঝিঙ্ঘান, আনোয়ার আলিদের ডিফেন্সের ব্যালান্সিং-কভারিং ভাল হবে বলাই বাহুল্য। কিন্তু টানা ম্যাচ জেতার জন্য কি শুধুই টেকনিক্যাল কারণ, না মাঠের বাইরের অনেক ছোট ছোট কারণও আছে?
এমনিতে ভীষণ হাসি-খুশি। দলের সব ফুটবলারদের জন্য সব সময় নিজের ঘরের দরজা হাল্কা করে ভেজানো থাকে। যে কোনও ফুটবলার যে কোনও সমস্যায়, যত রাতেই হোক নক করে ঢুকে যেতে পারেন। ফুটবলারদের এমনটাই স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন এই ক্রোয়েশিয়ান কোচ। কিন্তু পাশাপাশি ভারতের জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনই বেশ কিছু নিয়ম কানুন চালু করে দিয়েছেন সুনীল ছেত্রীদের (Sunil Chhetri) ড্রেসিংরুমে।
প্রথম নিয়ম, আর যাই হোক ম্যাচের আগে অথবা প্র্যাকটিসেও ড্রেসিংরুমে কখনোই মোবাইল ফোনে কথা বলা যাবে না। এমনকী কোনও ফুটবলারের ফোনের রিংটোনও ড্রেসিংরুমে শোনা না পসন্দ স্টিমাচের। এবার ফুটবলাররা ড্রেসিংরুমে ঢোকার আগে মোবাইলটি বাইরে রেখে আসবেন, না কি সাইলেন্ট মোড করে ঢুকবেন, না কি মোবাইল স্যুইচ অফ করে ঢুকবেন– সম্পূর্ণ তাঁর ব্যপার। কিন্তু ড্রেসিংরুমে কোনওমতেই মোবাইল বাজবে না।
আগে এরকম দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত। চাপ কমানোর জন্য ফুটবলাররা ছোট ছোট মিউজিক সিস্টেম হাতে নিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকতেন। এমনকি, ড্রেসিংরুমেও গান চালাতেন মন অন্যদিকে ঘোরাতে।
স্টিমাচ ফুটবলারদের হাতে যে নিয়মাবলী তুলে দিয়েছেন, তাতে পরিষ্কার লেখা আছে, ড্রেসিংরুমে জোরে আওয়াজ করে কোনও মিউজিক সিস্টেম চালানো যাবে না। একমাত্র মোবাইলে কল ফেসিলিটি বন্ধ করে শুধুই কানে ইয়ারপড লাগিয়ে মিউজিক শুনতে পারবেন। এর অন্যথা হলে স্টিমাচ কী ব্যবস্থা নিতে পারেন, তা শুধু সংশ্লিষ্ট ফুটবলারটিই জানেন।
স্টিমাচের ড্রেসিংরুম নিয়মাবলীতে এরপর যে নিয়মটি রয়েছে, তা অবশ্য বব হাউটন কোচ থাকার সময়েও প্রচলিত ছিল। ম্যাচ হারুক, জিতুক, কোনও ফুটবলার, কোনও ইস্যুতেই একে অন্যকে দোষারোপ করবেন না। ফুটবলারদের ভুল-ত্রুটি, প্রশংসা যা করার একমাত্র কোচ করবেন। এর পিছনে কারণ হল, ম্যাচের পর সব ফুটবলারই উত্তেজিত থাকেন। এই সময় একে অন্যের ভুল ধরতে শুরু করলে দলের ইউনিটি ভেঙে যেতে বাধ্য। আর খেলার পর ড্রেসিংরুমে ফুটবলাররা স্বাভাবিক ভাবে থাকেন না। তাই সেদিন কোনও আলোচনা না করে, যা বলার পরের দিন ক্লাসে শুধুই কোচ বলবেন।
স্টিমাচ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনও ফুটবলার যদি তাঁর বান্ধবী, কিংবা স্ত্রী নিয়ে জাতীয় শিবির চলাকালীন হোটেলে থাকতে চান, তাহলে কোচের কোনও আপত্তি নেই। বরং তিনি মনে করেন, ফুটবলারদের প্রিয় মানুষরা শিবিরে থাকলে ফুটবলাররা আরও ভাল থাকেন।
আবার কোনও ফুটবলারকে বাদ দিলে, আগে তাঁকে নিজের ঘরে ডেকে স্টিমাচ বোঝান, কেন বাদ দিচ্ছেন। তারপর তাঁর নাম ঘোষণা হয়। স্টিমাচ চান না, তাঁর সিদ্ধান্তর আগেই সংশ্লিষ্ট ফুটবলারটি অন্য মাধ্যম থেকে তাঁর রিপোর্ট কার্ড পান।
সারা বছর জাতীয় শিবির হয় না। কিন্তু জাতীয় ফুটবলাররা সারা বছর ফোনে ইগর স্টিমাচের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এমনকী ক্লাব পর্যায়ের প্র্যাকটিসে কোনও সমস্যা হলেও ফুটবলাররা জাতীয় কোচকে জানাতে পারেন। স্টিমাচ পরিস্থিতি বুঝে সংশ্লিষ্ট ক্লাবের কোচের সঙ্গে কথা বলেন।
এই যেমন রবিবার ভারতীয় শিবিরে ছিল ফুটবলারদের ছুটির দিন। পরিবার নিয়ে, অথবা একাই হোটেলের বাইরে গিয়ে নিজের মতো কাটানোর জন্য ছুটি দিয়েছিলেন কোচ। ৯ জুন জাতীয় শিবির শুরুর পর ২৫ জুন এসে প্রথম প্র্যাকটিস থেকে ছুটি মিলল ফুটবলারদের। দশ মাসের ছোট্ট সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে হোটেলের লনে ঘুরছিলেন সন্দেশ। শুভাশিস বসু বেরোলেন স্ত্রীকে সঙ্গী করে। প্রীতমের স্ত্রী আসছেন সেমিফাইনালে। গোলকিপার অমরিন্দর সিং, সাহাল, ছাংতে সবাই বাইরে ঘুরতে গেলেন। লবিতে বসে আছেন কোচ। আর যাওয়ার আগে সবাই হাত তুলে বাই বলে যাচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছিল সুখী পরিবার। কোচ হাসতে হাসতে বলছিলেন, “বিশ্বাস।বিশ্বাস। নেতাকে যদি ফুটবলাররা বিশ্বাস না করতে পারে, তাহলে সে কিছুতেই দল চালাতে পারবে না। আমি এই দলের প্রতিটি ফুটবলারকে বিশ্বাস করি। ফুটবলাররাও আমাকে একই রকম ভাবে বিশ্বাস করে।” আর মাঠের বাইরের এই বোঝাপড়াটাই প্রভাব ফেলছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.