কৃশানু মজুমদার: পাহাড়প্রমাণ স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী থাকল টোকিও অলিম্পিক (Tokyo Olympics)। দীপা কর্মকার হওয়া হল না পিংলার প্রণতি নায়েকের (Pranati Nayak)। টেলিভিশনের পরদায় বাংলার জিমন্যাস্টের দায়সারা পারফরম্যান্স দেখে কেঁদে ফেলেন প্রণতিকে তিলে তিলে গড়ে তোলা কোচ মিনারা বেগম (Minara Begum)। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের কাছে ক্ষোভ উগরে দিয়ে তিনি বলেন, “বিশ্রী পারফরম্যান্স করেছে। বিমে হতাশ করেছে। আনইভেন বারে পা ঠেকে গেল নীচে। তা হলে কী ট্রেনিং করল এতদিন?”
১৮ বছর ধরে প্রণতির পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন মিনারা। ছোট্ট ছাত্রীকে নিজের বাড়িতে রেখে প্র্যাকটিস করান। মা-বাবাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট অনুভব করতে দেননি কোনওদিন। নিজের মেয়ের মতো স্নেহ, আদর করতেন প্রণতিকে। অথচ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন টোকিওয় যেতে দেননি মিনারাকে। প্রণতির পারফরম্যান্স দেখে ক্ষুব্ধ প্রাক্তন কোচের একগুচ্ছ প্রশ্ন, “কেন একটা ভল্ট করল? দুটো ভল্ট না করলে পদক জেতা যায় না, পরের রাউন্ডে কোয়ালিফাই করা যায় না। ও তো সব জায়গাতেই দুটো ভল্টই করে। এখানে কেন করল না? আমার কাছে আগে থেকেই খবর ছিল অলিম্পিকে ও দুটো ভল্ট দেবে না।”
প্রণতির পারফরম্যান্স দেখার পরে সিনিয়র জিমন্যাস্টরাও বলছেন, তাঁকে দেখে কখনও মনে হয়নি পদক জিততে পারেন। এনার্জি কম ছিল বলেই মনে হয়েছে অনেকের। মিনারার প্রশ্ন, “অলিম্পিক কি রসিকতা করার জায়গা? নতুন করে কিছু তো শেখার ছিল না প্রণতির। যেটা জানে সেটাই বারবার করে অনুশীলনের দরকার ছিল। আমরা এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে যাওয়ার আগে একই জিনিস বারবার করে অনুশীলন করাই, যাতে আসল দিনে ওগুলোই করে আসতে পারে। প্রতিটা অ্যাপারাটাসে আজ অপ্রত্যাশিত খারাপ ফল করেছে।”
মিনারার আক্রমণের মুখে জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশন এবং প্রণতির কোচ লক্ষ্মণ শর্মাও। মিনারার তোপ, “টাইম পাস করেছে। প্র্যাকটিসটাই তো করেনি। কোচকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়। প্লেয়ার অলিম্পিকে যোগ্যতা অর্জন করেছে বলে প্লেয়ারের কথা শুনে চললে এরকমই হবে। জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন বা উপর মহলের মানসিকতা যদি এমন হয়, তা হলে ব্যর্থতাই সঙ্গী হবে। এত বড় ভুল হল কী করে? ব্যাকে আজকে ৩৬০ করেছে। ফ্রন্টেও তো ৩৬০ করার কথা ছিল। সেটাই তো করল না। তার মানে ও প্র্যাকটিস করেনি। আমার ট্রেনিংয়ে ৭২০ করেছে। ভল্ট টেবিলে কোয়ালিফায়েড হতে গেলে দুটো ভল্ট করতেই হয়। না হলে কোয়ালিফাই করার কোনও জায়গাই নেই। আমার কথা খুব সহজ। তুমি সাফল্য পাও আর চাই না পাও, যেটা জানো সেটা ঠিকঠাক করে এসো। যে প্র্যাকটিস করা উচিত ছিল, কোচের অনভিজ্ঞতার জন্য সেটাই হল না। এতটা খারাপ পারফরম্যান্স করবে আমি আশা করিনি।”
মিনারার দাবি, টোকিও পৌঁছনোর পর থেকেই প্রণতি একের পর এক ছবি পোস্ট করেছেন সোশ্যাল মিডিয়া। ছাত্রীর এহেন কাজে অসন্তুষ্ট অভিজ্ঞ কোচ। মিনারা বলছেন, “এত ছবি পোস্ট করার কারণ কী? রিও অলিম্পিকে যাওয়ার পর থেকে দীপা কি এত ছবি পোস্ট করেছিল? বিশ্বেশ্বর নন্দী ওর সঙ্গে গিয়েছিল। ছাত্রীর যাতে ফোকাস না নড়ে, সেই চেষ্টাই করে গিয়েছিলেন দীপার কোচ।”
মিনারা আরও বলছেন, “একজন জুনিয়র কোচ তো আর প্লেয়ার তৈরি করে না। তাই বুঝবে না আমার বুকে কতটা লাগছে। আমি তৈরি করলাম, আর এভাবে আমার স্বপ্ন ভেঙে গেল। আমি টিভির সামনে বসে কেঁদেছি। এটা এশিয়ান বা কমনওয়েথ গেমস নয়। অলিম্পিককে হালকা হিসেবে নিল। আমি গেলে অনেক নিয়ম মেনে চলতে হতো ওকে। আমার কোচিংয়েও অনেক জায়গায় গিয়েছে প্রণতি। আমাদের আগেই বলেই দেওয়া হত, দেশে ফিরলে তবেই ছবি পোস্ট করবে। আমার তো সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, ফোটোসেশনই হয়েছে। আর কিছু হয়নি।”
টোকিও যাওয়ার আগে প্রণতি বলেছিলেন, ২ মাসের প্র্যাকটিস করে তিনি অলিম্পিকে যাচ্ছেন। এত অল্প সময়ের অনুশীলন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন বাংলার জিমন্যাস্ট। মিনারা বলছেন, “আমাকে তো ফেডারেশনের তরফ থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি কি অনলাইনে প্রস্তুতি করিয়েছেন? কত বড় বড় কথা বলা হল। আমার হাতে তৈরি প্রণতি, সেই আমাকেই অনুশীলনে ঢুকতে দেওয়া হল না। অন্যসময় হলে আমি হয়তো হাজিরও হতাম ওদের অনুশীলনে। কিন্তু অতিমারী পরিস্থিতিতে গ্রিন জোন তৈরি করে আলাদা করে ট্রেনিং করানো হয়েছে।”
সবকিছুর মধ্যেই চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছেন মিনারা। জিমন্যাস্টিক্সের সার্কিট থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে দাবি অভিজ্ঞ কোচের। মিনারা বলছেন, “ওদের তো আমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। আমি একজন অলিম্পিয়ান তৈরি করেছি। আমাকে জিমন্যাস্টিকস থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সেই কারণেই অলিম্পিকে যেতে দেওয়া হল না আমাকে।”
অভিজ্ঞ কোচ এখন হাত কামড়াচ্ছেন। এশিয়ান কোটায় এবার মেগা ইভেন্টের ছাড়পত্র জোগাড় করেছিলেন প্রণতি। কিন্তু সেই সুযোগও হেলায় হারালেন। আর কি সুযোগ আসবে? ভূমিকম্পের দেশে স্বপ্নভঙ্গের পরে নতুন করে আর স্বপ্ন দেখছেন না মিনারা বেগম।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.