সাহিত্যের পাতায় নয়, তিনি প্রকৃত অর্থেই বাস্তবের ‘ক্ষিদ্দা’। শুধু নিজের প্রতিভায় জগৎসভায় ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছেন তা-ই নয়, এই দেশ তাঁর দৌলতেই পেয়েছে আরও দুই নক্ষত্রকে। ভারতীয় ব্যাডিমিন্টনের মানচিত্রটিকে যিনি প্রায় নিজের হাতে বদলে দিয়েছেন, তিনি দেশের ‘গোপীস্যর’, পুল্লেলা গোপীচাঁদ (Pullela Gopichand)। বিমানবন্দরে দিল্লির উড়ান ধরতে যাওয়ার আগে কল্লোলিনীকে সাক্ষী রেখে অরিঞ্জয় বোসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে উজাড় করে দিলেন মনের কথা।
বাংলা সাহিত্যে ‘ক্ষিদ্দা’ নামে এক আইকনিক চরিত্র আছে। যাঁর প্রশিক্ষণ কিংবদন্তিতুল্য। আমরা বাঙালিরা আপনাকে এই নামেই ডাকি। আপনার প্রশিক্ষণেই আমরা পেয়েছি সাইনা নেহওয়াল, পি ভি সিন্ধুর মতো দুই তুখোড় খেলোয়াড়কে, যাঁরা আবার সুপারস্টারও বটে। এঁদের মতো তারকাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটা কতখানি কঠিন?
গোপীচাঁদ: আমি তো ওঁদের অনেক ছোট থেকেই, বলতে গেলে সেই শুরুর দিন থেকেই দেখছি। লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখে ওঁরা যেরকম সুপারস্টার, আমি ওঁদের সেভাবে দেখি না। ওঁরা কিন্তু দু’জনেই খুব ভাল ছাত্রী। আর একটা গুণ দুজনের মধ্যেই দেখেছি যে, দুজনেই সহজে হার মানতে নারাজ ওরা। এই ইস্পাতকঠিন মানসিকতা আমার খুব ভাল লাগে। এতগুলো বছর ধরে ওদের সঙ্গে কাজ করা তাই আমার কাছে বেশ আনন্দেরই অভিজ্ঞতা।
আপনি একবার বলেছিলেন যে, সিন্ধু ব্যাডিমিন্টনের ফেডেরার হয়ে উঠবে একদিন। আপনি কি এখনও সেই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত?
গোপীচাঁদ: আমি এখনও বিশ্বাস করি যে, সিন্ধুর মধ্যে সেই প্রতিভা আছে। ওরকম একটা উচ্চতায় উঠতে, দুনিয়া শাসন করতে যেরকম শারীরিক সক্ষমতা প্রয়োজন, তা-ও ওর আছে। বয়সও তো এখন মোটে ছাব্বিশ-সাতাশ। আমার মনে হয়, উইমেনস সিঙ্গলসে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হয়ে ওঠার সবরকম যোগ্যতাই সিন্ধুর আছে।
আমরা জানি, আপনার দর্শন খুব অন্যরকম। আমি জানিতে চাই, কী সেই দর্শন, যা আপনাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রমাগত উৎসাহ জুগিয়ে যায়?
গোপীচাঁদ: ব্যাডমিন্টনে ভারত বরাবর একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে এসেছে। ভারতীয়দের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কথা মাথায় রাখলে, আমরাও যে এই খেলায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারি, তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমার দর্শন এখানে খুব সাধারণ। আমি বিশ্বাস করি যে, আমি যদি সফল হতে পারি, তাহলে দেশের আরও অনেকেই এই সাফল্যের বিন্দু স্পর্শ করতে পারেন। এই ভাবনাই আমাকে প্রশিক্ষণে উৎসাহ দেয়। এভাবেই আমি ভাবতে ভালবাসি, এই দর্শনেই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।
তাহলে ব্যাডমিন্টনে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কি খুবই আশাবাদী? বা আপনার চোখে বিষয়টি কীরকম?
গোপীচাঁদ: আজ অনেকেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। ব্যাডমিন্টনকে ঘিরেই যে তাঁদের স্বপ্ন, এটা যখন দেখি, তখন আশাবাদী না হয়ে উপায় নেই। বর্তমানে এই খেলাকে উন্নত করতে পরিকাঠামোগত যে পরিবর্তন হয়েছে, কর্পোরেট সাপোর্ট বা সরকারি উদ্যোগ যেদিক থেকেই দেখি না, একটা সদর্থক পরিবর্তনই দেখতে পাই। দেশের বহুসংখ্যক মানুষ ব্যাডমিন্টন খেলছেন, খেলতে চাইছেন- এর থেকে ভাল লাগার আর কী হতে পারে! আমার বিশ্বাস, ‘ব্যাডমিন্টন নেশন’ শব্দটি যদি প্রয়োগ করি, তবে আমাদের দেশের তা হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা আছে। এবং দীর্ঘদিন ধরে এই খেতাব সে নিজের দখলেই রাখতে পারে। আর একটু বিনিয়োগ, আরও একটু পরিশ্রম দরকার। আর চাই সেই জোরালো বিশ্বাস যে, আমরাও পারি। অতীতে বা সাম্প্রতিক অতীতেও ব্যাডমিন্টন র্যাকেট হাতে অনেকেই সাফল্য পেয়েছেন। যা নিশ্চিত অনুপ্রেরণা জোগাবে। এবার পালা পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার।
কিন্তু গোপীস্যার, অনেকেই বলে থাকেন ভবিষ্যতে হয়তো আর-একজন সিন্ধু আসবেন, কিন্তু গোপীচাঁদ অদ্বিতীয়। আপনি নিজে কীভাবে বিষয়টি দেখেন?
গোপীচাঁদ: (সবিনয়ে হেসে) আমার মনে হয় খেলার সময়টা ছিল সবথেকে সহজ। কেননা আমি কী করতে চাইছি, সেইমতো নিজের লক্ষ্য স্থির করে পারফর্ম করি। আমি তো সৌভাগ্যবান যে, আমার খেলোয়াড়ি জীবনের যাত্রাপথে আমার পরিবারের সকলে পাশে থেকেছেন। বহু মানুষ আমাকে ভালবেসেছেন। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে যখন কোচিং-এ এলাম তখনও একই অভিজ্ঞতা, একই রকম ভালবাসা পেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, একজন ভাল কোচই একটা খেলাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, পরবর্তী স্তরে উন্নীত করতে পারেন। আমাদের দেশ যদি খেলায় উন্নতি করতে চায়, তবে প্রশিক্ষকদের প্রতি আরও নজর দিতে হবে। বিনয়োগের দিক থেকে এবং সম্মান-সম্ভ্রমের দিক থেকেও। আমি কোচ হিসাবে যে ভালবাসা-সম্মান পেয়েছি, তাতে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। তবে এমন অনেক কোচ আছেন, আমি জানি, যাঁদের আরও সম্মান প্রাপ্য। ভারতীয় ক্রীড়াজগতের এই একটি অনুজ্জ্বল দিক, যেদিকে আরও নজর দেওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি।
অল ইংল্যান্ডের আসর তো প্রায় শুরু হতে চলল। সেখানেও তো গোপীচাঁদ ছাড়া ভারতের সাফল্যের খতিয়ান শূন্য। এবার ভারতের কতটা আশা আছে বলে মনে হচ্ছে?
গোপীচাঁদ: বেশ কয়েকবার ফাইনালে পৌঁছেছি আমরা। তবে জয় অধরা থেকেছে। আমি আশাবাদী যে, এবার আমরা সেই লক্ষ্যে পৌঁছাব। বেশ কয়েকটি ইভেন্টে এই সম্ভাবনা আছে। ব্যাডমিন্টনের এতবড় আসরে যেমন শারীরিক সক্ষমতা জরুরি, তেমন সহনক্ষমতাও। এই মুহূর্তে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় আছেন, যাঁরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সক্ষম।
তাই এবার ভারত আবার জগৎসভায় সেরা হবে, সেটাই আমার বিশ্বাস।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.