অংশুপ্রতিম পাল, খড়গপুর: প্রণতি নায়েকের (Pranati Nayak) অগ্নিপরীক্ষা ২৫ জুলাই। সেদিন সকালে টোকিওয় নামছেন পিংলার মেয়েটি। গোটা দেশের নজরে প্রণতি। তাঁর পদক জয়ের দিকে তাকিয়ে তাঁর গ্রামও। উৎসুক তাঁর পরিবারও। কিন্তু কোন চ্যানেলে দেখা যাবে মেয়ের পারফরম্যান্স? জানেনই না বাবা শ্রীমন্ত নায়েক। আর সেজন্যই কেবল অপারেটরকে বলে সমস্ত টিভি চ্যানেলেরই সাবস্ক্রিপশন নিয়ে ফেলেছেন তিনি। কথায় কথায় এমনটাই জানিয়েছেন। কোনওভাবেই মেয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্ত মিস করতে চান না।
অজ পাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা প্রণতিই এবার টোকিও অলিম্পিকে (Tokyo Olympics) ভারতীয় জিমন্যাস্টিক্স দলের একমাত্র প্রতিনিধি। পিংলা থানার করকাই গ্রামের মেয়ে প্রণতির এই উত্থান যেন রূপকথাকেও হার মানাবে। সেই আট বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে সল্টলেকে সাই শিবিরে গিয়ে উঠেছিলেন। সেখান থেকেই টোকিওয় পাড়ি দেওয়া। মেয়ের এই কৃতিত্বে বাবা ও মা’তো বটেই তাঁর সঙ্গে প্রথম শিক্ষাগুরু থেকে শুরু করে গ্রামের বাসিন্দারা পর্যন্ত গর্বিত। পিংলা থানার ১১ মাইল থেকে কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে আরও ৩ কিমি পাকা রাস্তা ধরে এগোলে করকাই গ্রাম। এই গ্রামেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল। তাঁর মা প্রতিমা নায়েকের ভাষায়, “দু’বছর বয়স থেকে ও ডানপিটে ছিল। যে সময় শিশুরা মায়ের আঁচলে লুকিয়ে থাকার কথা সে সময় থেকেই ও ছুটে বেড়াত। আর একটু বড় হওয়ার পর জলে সাঁতার কাটা থেকে গাছের ডালে চড়ে বেড়াত।” অত্যন্ত গরিব পরিবারের সন্তান ছিল প্রণতি। তিন বোনের মধ্যে মেজো।
এখন প্রণতির জন্যই পরিবারের সুদিন ফিরেছে। কিন্তু একসময়ে পরিবারে অভাব ছিল নিত্যদিনের কাহিনি। বাবা শ্রীমন্ত নায়েক বাস চালাতেন। তাও সাতদিনের বেশি কাজ জুটত না। এই অবস্থায় একদিন গ্রামের এক যুবক পাশেই সবং থানার তেমাথানি এলাকার মনসারাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাধানাথ শীটের কাছে গিয়ে এই একরত্তি মেয়েটির ব্যাপারে জানায়। তখন তিনি প্রণতিকে নিয়ে আসতে বলেন। তারপর সেই যুবক প্রণতিকে নিয়ে যায় রাধানাথবাবুর কাছে। এই প্রসঙ্গে রাধানাথবাবু জানান, “ঝাঁকরা চুলের এক রত্তি এই মেয়েটিকে দেখে ভালো লেগে যায়। আমার বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করি। কিন্তু পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারায় কিছুদিন পর বাড়িতে ফিরে যায়। তারপর বাড়িতে থেকেই তাঁকে নিয়ে মেদিনীপুর ও খড়গপুর শহরে নিয়ে যাওয়া হয় জিমন্যাস্টিকসের প্রশিক্ষণের জন্য। সেই শুরু।” ২০০৩-০৪ সালে জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় গায়ে পক্স নিয়ে ফাইনালে নামে। প্রথম হয়। এই প্রসঙ্গে রাধানাথবাবুর বক্তব্য, “সেদিনই বুঝেছিলাম অসম্ভব কষ্ট সহিষ্ণু মেয়ে।”
আর এবার টোকিও অলিম্পিকে অংশগ্রহণের পিছনে তাঁর নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রম রয়েছে বলে প্রণতির প্রথম শিক্ষাগুরু জানিয়েছেন। কন্যাসম ছাত্রীর সাফল্য কামনা করে তিনি বলেন, “প্রণতির অলিম্পিকে যাওয়া আমার বা আমাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের বিষয় শুধু নয় স্বপ্নেরও বাইরে। আমি ওর সাফল্য কামনা করি। আশা করি ও অলিম্পিক থেকে পদক জিতে নিয়ে শুধু দেশের নয় এই গ্রামের মুখও উজ্জ্বল করবে।” আর বাবা শ্রীমন্ত নায়েক বললেন, “খুব খুশি। অনেক কষ্ট করে ও এতদূর এগিয়েছে। পদক পাবে। এই স্বপ্ন এখন দেখছি।” আর ছোটবেলার বন্ধু কুন্তলা পাল বললেন, “আমি যে ওর বন্ধু সেটা ভেবেই গর্ব বোধ করছি।” তবে আফসোস স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে সর্বোচ্চ স্তরের প্রাপ্য সম্মান তিনি পাননি। এই ব্যাপারে গ্রামের বাসিন্দা তথা করকাই বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের কেরানি দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরী বললেন, “পাকা রাস্তা থেকে বাড়িতে ঢোকার একশো মিটার রাস্তাটি আজ পর্যন্ত পাকা কিংবা ঢালাই করে দেওয়া হল না। সেই কাঁচাই রয়ে গিয়েছে।” অলিম্পিকে ২৬ বছরের এই দামাল মেয়ের পারফরম্যান্সের দিকেই নজর গ্রামবাসীর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.