কৃশানু মজুমদার: তিনি ঈশ্বর। ক্রিকেট ঈশ্বর।
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী একসময়ে মাতাল হতো তাঁর জন্য। তিনি ক্রিজে নামা মানেই গোটা দেশে জারি হয়ে যেত অঘোষিত কার্ফু। প্রকৃত অর্থেই দেশে হতো লকডাউন। তিনি আমাদের বড় আবেগের, বড় প্রিয় শচীন রমেশ তেণ্ডুলকর (Sachin Tendulkar)। গর্ব করে বলতাম, ”আমাদের একজন শচীন তেণ্ডুলকর আছেন।”
তিনি আবার ক্রিকেট রোম্যান্সের নতুন এক অধ্যায়। ক্রিকেট যদি ধর্ম হয়, তিনি তাহলে তার সাক্ষাৎ সাধক। তিনি বিরাট কোহলি (Virat Kohli)। ঘাম-রক্তের পথ অতিক্রম করে যিনি শৌর্য-বীর্যের পোশাক পরিহিত এক নাইট।
শচীন এবং বিরাট আসলে ক্রিকেট ইতিহাসের দুই অধ্যায়। দুই সময়ের প্রতিনিধি। দুই প্রজন্মের মহানায়ক। দেশের হৃদস্পন্দন।
একজন ইতিমধ্যেই ক্রিকেট ঈশ্বরের বেদিতে অধিষ্ঠিত। অন্য একজন রাজপাট চালাচ্ছেন। লড়াকু মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন। দিনের শেষে সেই তিনিই মনে করিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন, ”পরিশ্রম, পরিশ্রম এবং পরিশ্রমের কোনও বিকল্প হয় না।”
ঈশ্বরের আসনে এখনও তিনি উপবিষ্ট হননি। কিন্তু ঈশ্বরকে ছোঁয়ার এক মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। সবুজ ঘাসের মাঠে তিনি ঘাম ঝরান, আবেগের বিস্ফোরণ ঘটান। তিনি কাঁদেন, রাগেন, হাসেন। অসম্ভবকে সম্ভব করেন। তাঁকে দেখে আমাদের চোখ থেকে নামে শ্রাবণের ধারা। তাঁর সুখে আমরা সুখি। তাঁর দুঃখে দুঃখী। তিনি ছুঁয়ে যান আমাকে-আপনাকে, গোটা দেশকে। আজ তাঁরই জন্মদিন।
গোটা দেশের শ্বাস-প্রশ্বাসে আজ শুধুই বিরাট আর বিরাট। একবুক ভালোবাসা, আবেগ উজাড় করে দেশ যেন সুর ধরেছে, ”দিন যায়, রাত আসে, মাস যায়, বছর আসে, সবাই থাকে সুদিনের আশায়, আমি থাকি শুধু তোমার জন্মদিনের আশায়!”
বাণিজ্যনগরীর শচীন ক্রিকেটের সর্বোত্তম সহজাত প্রতিভা। মাঠে নামলেই অপেক্ষা করে থাকত ম্যাজিক। তাঁর গাণ্ডীবকে ভয় পেত বিশ্বত্রাসী সব বোলাররা। পড়শি দেশের শোয়েব আখতার শ্রদ্ধাবনত হয়ে বলতেন, ”শচীন তো মানুষ নয়। ও ঈশ্বর। শচীন আমাদের সবার ধরাছোঁয়ার বাইরের এক জগতের বাসিন্দা।” ঈশ্বরদত্ত এক প্রতিভা অনায়াস দক্ষতায় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করেছিলেন।
কোহলি অবশ্য বিরাট হয়ে উঠেছেন কঠোর পরিশ্রমে, অধ্যবসায়ে, ঘাম ঝরিয়ে। তাঁর এগিয়ে চলার পথ মোটেও পাপড়িবিছানো ছিল না। বরং তা ছিল কাঁটায় মোড়ানো। নিন্দুকদের নখ-দাঁতের আঁচড়ে রক্তাক্ত হয়েছেন, আগ্রাসন দেখিয়ে নিন্দিত হয়েছেন। তিনিই আবার সংকল্প করেছেন, হলে মহীরূহই হবেন। ক্রিকেট ইতিহাসে যেন স্বর্ণাক্ষরে খোদিত থাকে তাঁর নাম।
তিনিই আবার প্রেরণার আরেক নাম। সেই কোন ছেলেবেলায় ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড বাবাকে হারিয়েছেন। বাবার কথা বললে, এখনও চোয়াল হয়ে যায় কঠিন। একবার এক টিভি সাক্ষাত্কারে বাবার প্রসঙ্গ উঠতেই চুপ করে গিয়েছিলেন বিরাট। মুখচ্ছবি বদলে গিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। গলার স্বর নামিয়ে প্রসঙ্গ ঘোরানোর চেষ্টা করছিলেন। অভিজ্ঞ সঞ্চালক কোহলিকে মাঝপথে থামিয়ে বলেছিলেন, ”আপনি পুরো ঘটনাটা বলুন প্লিজ। আপনার এই কঠিন লড়াই অনেক মানুষকে প্রেরণা জোগাবে।”
বিরাট কোহলি এক লড়াইয়েরও নাম। হাল ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নন তিনি। মেলবোর্নের ওই বিশালাকায় মাঠে পাকিস্তানের গতিদানব হ্যারিস রউফকে মারা দুটো ছক্কা আজীবন মনে রাখবে দেশ। ৮ বলে ২৮ রান তাড়াও উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়।
আমার মতো অতি সাধারণ এক কলমচি প্রতি রাতে সেই বিরাট-রান তাড়া দেখি। আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। মনে জোর বাড়ে। গভীর রাতে অস্ফুটে নিজেকে বলি, ”বিরাট কোহলি পারলে আমি পারব না কেন?” ক্রিকেটার বিরাট কোহলি আমার-আপনার মতোই যে এক মানুষ।
বিরাট কোহলিকে দেখে মনে হয় পাশের বাড়ির সেই ছেলেটা। যে একসময়ে বিপথগামী হয়েছিল। আইপিএলের রংবাহার দেখে পার্টিতে মজে থাকত রাতভর। তখন ভারত সদ্য অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জিতেছে। দিল্লির ছেলেটা ক্যাপ্টেন। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর ২০ লাখ টাকায় কিনে নিল তাঁকে। আইপিএলের প্রথম সংস্করণ। সেই সময়ে ২০ লাখ টাকাই বিশাল ব্যাপার। ছেলেটা অন্য পৃথিবীতে পৌঁছে গেল। সে তখন উড়ছে। হাতে টাকা, বিশ্বজয়ী দলের অধিনায়ক, সামনে স্বপ্নের সব তারকারা। খেলার শেষে পার্টি হত। যৌবনের তেজ তখন। পার্টি, পার্টি আর পার্টিতে মেতে উঠল বাবা হারানো ছেলেটা। ওর কোচ বলতেন, ”বড্ড বেশি পার্টি করছ তুমি।”
আইপিএলে পর পর ব্যর্থ হচ্ছিল সে। সবাই বলছিল বখে যাওয়া, উচ্ছৃঙ্খল ছেলে। একদিন আয়নায় চোখ পড়ল। অন্তরাত্মা বলে উঠল, ”এরকম বেঢপ চেহারা নিয়ে তুমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবে।”
চোখ খুলে গেল ওর। ভিতরে ঝড় উঠল। নিজেকে নিজেই বলে উঠল, ”আর এভাবে নয়।” পরের দিন থেকে শুরু হল কঠিন সাধনা। ছেলেটার ফিটনেস এখন মনে করিয়ে দেয় সেই পুরনো বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন, পড়শির ঈর্ষা, গৃহস্থের গর্ব। ওই কঠিন অনুশীলনের ফলে ৬-৮ কেজি ওজন ঝরেছিল। বিরাট কোহলি বলতেন, ”মাঠে মনে হত আমি উড়ছি। নিজেকে অনেক হাল্কা লাগত।”
বিরাট কোহলি এখনও নিজেকে ভেঙে চলেছেন। গ্রিপ নিয়ে খেটেছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। ফিটনেসকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্ত এক উচ্চতায়। তবেই সামনে এসেছে চ্যাম্পিয়নের অবয়ব। কুর্নিশ করছে গোটা বিশ্ব।
ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ চলছে এখন। এক যুগ আগের এক বিশ্বকাপে ভারত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। চার বছর পরে সেই ছেলেটার ব্যাটের দিকেই তাকিয়ে ছিল দেশ। জেতালে এই ছেলেটাই পারবে। এমন বিশ্বাস জন্মেছিল দেশবাসীর। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে স্বপ্নভঙ্গ হয় ভারতের। বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেল ভারত। ছেলেটার ব্যাট বোবা থেকে গেল। গ্যালারিতে সেদিন ছিল ওর প্রেমিকা অনুষ্কা শর্মা। দেশ হেরে যাওয়ায় সমর্থকদের রাগ গিয়ে পড়ল ওই অভিনেত্রীর উপরে।
সবাই সমস্বরে বলে উঠল, ”তুমি অপয়া। তোমার জন্যই বিরাট রান পায়নি। দেশ হেরেছে তুমি ছিলে বলে।” ছেলেটা ভাবল এ কেমন বিচার! যাঁর সঙ্গে খেলার কোনও সম্পর্কই নেই, তাঁকে কিনা আগুনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে! কলকাতায় এক সাংবাদিক বৈঠকে বিস্ফোরণ ঘটাল ছেলেটা। সেই বিস্ফোরণ শুনে মনে হচ্ছিল, এ ছেলে তো আমার বাড়িরই এক ছেলে। অন্যায় সহ্য করতে পারে না। প্রতিবাদ করে ওঠে।
ওর নেতৃত্বে ভারত মেঘের উপর দিয়ে হাঁটছিল। যেখানে হাত দিয়েছে, তাতেই সোনা ফলিয়েছে। বিশ্বকাপ না জিতলেও দ্বিপাক্ষিক সিরিজে মারাত্মক সাফল্য। সহ্য হল না অনেকের। ব্যর্থ, তুমি ব্যর্থ। তোমার ব্যাটে রান নেই..সেঞ্চুরি নেই..তুমি বিরাট কোহলি, তোমার কাছ থেকে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর চাই না। একশো, পারলে দুশো করো..তারও বেশি হলে আরও ভাল। ভুলে গেলাম সবাই, ওই ছেলেটাও রক্তমাংসের মানুষ। পাহাড়সমান চাপ সহ্য করা কি মানুষের কাজ! প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল।
ছেলেটা কিন্তু অন্য ধাতুতে গড়া। চাপ অনুভব করে বলে মনে হয় না। কোথায় যেন একবার বলেছিল,”কখনও কখনও আমি বোলারকে দেখতে পাই না। দেখতে পাই না প্রতিপক্ষকেও। গ্যালারির শব্দব্রহ্ম আমার কানে ঢোকে না। আমি ব্যাট করার সময়ে দেখি কেবল বল। বলের গতিপথ। তার পরে কাজ করে শুধু ইনস্টিঙ্কট।” সেই ছেলে অসম্ভবকে সম্ভব করার এক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
নেতৃত্ব গিয়েছে। প্রচার করা হয়েছে ছেলেটার সঙ্গে বনে না সতীর্থদের। ওর সঙ্গে এর সমস্যা, ওর সমস্যা। ভয়ঙ্কর ইগো, খুব অ্যাটিটিউড। একদিন যারা তাঁকে রক্তাক্ত করেছিলেন, তারা এখন সবাই চুপ। পারফর্মাররা তো এভাবেই চুপ করিয়ে দেন সমালোচকদের। চলতি বিশ্বকাপে বিরাট বনস্পতি হয়ে দেখা দিচ্ছেন। তিনিই মিস্টার ইন্ডিয়া।
আমি ধর্ম, আমি অধর্ম, আমি ব্রাহ্মণ, আমি মেথর,
আমি রাস্তা ঝাঁট দিই, আমি ইটভাটায় ইট তুলি
আমি কলেজে পড়ি, আমি জেলখানায়
আমি মাঠে, আমি বস্তিতে, আমি বারোতলায় …
আমাকে চিনলে না?
আমি ভারতবর্ষ।
ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম। সেই সূর্য বিরাট কোহলি।৪৮টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির মালিক তিনি।
শচীনের ৪৯টি ওয়ানডে শতরানের মাইলফলকে পৌঁছতে বাকি মাত্র একটি শতরান। ঈশ্বরকে-সিংহাসনচ্যুত করতে উদ্যত কোহলি।
আজ জন্মদিনে নেমে পড়ছেন ক্রিকেটের মৃগয়াক্ষেত্র ইডেন গার্ডেন্সে। প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা। শচীনের শহরে অল্পের জন্য ছোঁয়া হয়নি ‘মাস্টার ব্লাস্টার’কে। অপেক্ষা বেড়েছে দেশের। ইডেনে জন্মদিন উদযাপন করার স্টান্স নিচ্ছেন। ইতিহাসের সাক্ষী থাকবে কলকাতা? নাকি প্রতীক্ষা দীর্ঘায়িত হবে? বিশ্বকাপ নাকি বিশ্বকাপোত্তর কোনও দ্বিপাক্ষিক সিরিজ?
ঈশ্বরের মহার্ঘ্য রেকর্ড ভাঙলে রক্তমাংসের কোহলিই পারবেন। একশোয় একশো করে গিয়েছেন ঈশ্বর। তা স্পর্শ করা প্রায় অসম্ভব এক কাজ। অসাধ্যসাধন করার সাধনায় মগ্ন মানবপুত্র। বিরাট-গাড়ি এগোচ্ছে ঈশ্বরকে ছোঁয়ার হাইওয়ে ধরে। হয়তো একশো সেঞ্চুরির কাছে পৌঁছবেন, হয়তো আগেই থেমে যাবে বিরাট-রূপকথা। অপার্থিব মাইলস্টোন ছুঁয়ে ফেলাও কি খুব অসম্ভব তাঁর কাছে? সময়-ঘড়ি এর উত্তর দিয়ে যাবে।
ভাবীকাল তাঁর মূল্যায়ণ করতে বসে বলবে, একজন মানুষ অন্তত ঈশ্বরকে ছোঁয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। তাঁর নাম বিরাট কোহলি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.