গৌতম ভট্টাচার্য: একটা টিম টানা চার ম্যাচ হেরে আতঙ্কের চোরাবালিতে ক্রমশ সেঁধিয়ে যাচ্ছে। একটা টিম টানা চার ম্যাচ জিতে উত্তুঙ্গ চাপ নেওয়া অভ্যেস করে ফেলেছে। ড্রয়িংরুমের ক্যালকুলেশনে দু’টো টিমের মধ্যে বিজয়ী নির্বাচিত করে ফেলায় কোনও সমস্যা নেই। কেকেআর এবং একমাত্র কেকেআর! সমস্যা হল ড্রয়িংরুম বা ল্যাপটপের প্রস্তুতিতে ম্যাচ খেলা সহজতর হতে পারে। আরও নিঁখুত হতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ক্রিকেট মাঠের বাইরেটা ভিতরকে নিশ্চিত নিয়ন্ত্রণ করার মতো অব্যর্থ ওষুধ বার করতে পারেনি। বরঞ্চ অনূর্ধ্ব পনেরো থেকে একশো টেস্ট খেলা পেশাদার- সবাই এক কথা বলবে। ওই বিশেষ দিনটায় সকালে উঠে কী মাইন্ডসেট জমাট বাঁধল? ম্যাচের মধ্যে কতটা আক্রমণাত্মক ভাবে মনকে আগাম ঢুকিয়ে দেওয়া গেল? ছোট ফরম্যাটের ক্রিকেটে এগুলোই চূড়ান্ত নির্ণায়ক।
তাই কেকেআর এক সপ্তাহ জুড়ে যতই প্রতাপ দেখাক, সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে ইডেনে অবিসংবাদী ফেভারিট বলার সুযোগ নেই। উল্টে এ দিন মুম্বই থেকে কেকেআর মেন্টর অভিষেক নায়ারকে তাঁর ক্রিকেটীয় সুহৃদরা কেউ কেউ বলছিলেন, “পিচ কোনওমতে স্পিনিং সহায়ক করতে যেও না। রশিদ খান আর সাকিব তোমাদের উড়িয়ে দেবে।” সাকিব এই টুর্নামেন্টে অবশ্য সানরাইজার্স স্পিন অ্যাটাকের রাধাকান্ত নন্দী। মান্না দে? অবশ্যই রশিদ খান। আফগান এই রিস্ট স্পিনারের এবারের অভিযান নিয়ে জটায়ু বই লিখলে নির্ঘাত নাম হত- আইপিএলে শিহরণ। গত কয়েক বছর হালকা ঘুরতে ঘুরতে এ বারের টুর্নামেন্টে টি টোয়েন্টি ক্রিকেট লেফট টার্ন করে আচমকা এমন হাইওয়েতে পড়েছে, যা হয়তো তার নিজের কাছেও অপ্রত্যাশিত। সাধারণ ধারণা হল আইপিএল মানে চিয়ারগার্লস, বিশাল বিশাল ছক্কা, আলো, বাজনা, গান, গ্ল্যামার— সব মিলিয়ে একটা মোচ্ছব। বিনোদনের অফুরন্ত ঠিকানা যেখানে বলিউড-টলিউডও মুহুর্মুহু ঢুকে পড়ে। বৃহস্পতিবার যেমন শুনলাম কাল স্টার স্পোর্টসে কিছুক্ষণ মারাঠি কমেন্ট্রি করবেন মাধুরী দীক্ষিত!
কিন্তু এগুলো নিছক বহিরঙ্গ। ভেতরটা ঠাসা ক্রিকেটীয়। আর তা বদলে দিয়েছেন রশিদ খান-মায়াঙ্ক মারকান্ডে-যুজবেন্দ্র চাহালরা। ক্রিকেটের আদিমকাল থেকে একশো চল্লিশ বছর অবধি ধারণা ছিল অফ স্পিনার রানটা আটকাবে, লেগ স্পিনার দেবে। কারণ তাকে উইকেট কিনতে হবে। একাত্তরের সোনা ঝরা ইংল্যান্ড সফরে এরাপল্লি প্রসন্নকে বাদ দিয়ে ভেঙ্কটরাঘবনকে খেলিয়েছেন ওয়াদেকর। তিন টেস্টেই। আজও সেই মহাবিতর্কিত সিদ্ধান্তের রেশ রয়ে গেছে বললে ওয়াদেকর ঘাড় নাড়েন, “চন্দ্র রান দেবে। বেদী দেবে। তা হলে আটকাবে কে? আটকাবে সেই অফ স্পিনার যে ফ্লাইটটা প্রসন্নর চেয়ে কম করায়। সেই লোকটা ছিল ভেঙ্কট।”
এখন ঠিক উলটো। অনের দিকে এত সব শট বাজারে বেরিয়ে গিয়েছে। ব্যাটিং ক্রিজের ব্যবহার সদ্য অবসৃত এক এবি ডি ভিলিয়ার্সের মাহাত্ম্যে এমন বৈপ্লবিক হয়ে গিয়েছে যে শরীরে বল করেছ কী চার-ছয়। বরঞ্চ শরীর থেকে দূরে বল করো যা ফিঙ্গার স্পিনার নয়, রিস্ট স্পিনার করে থাকে।আগেকার দিনে লেগস্পিনারের গুগলি আর সাধারণ লেগস্পিনের গতির বিশেষ তফাত হত না। জোরে বল বলতে ধরা হত ফ্লিপার। অধুনা সেটাও বদলে গেছে। কোয়ালিফায়ার ওয়ান ম্যাচটায় ধোনি যে গুগলিতে বোল্ড হয়েছেন সেটা রশিদ করেছিলেন ঘণ্টায় ৯৫ কিলোমিটার গতিতে। তাঁর নর্ম্যাল ডেলিভারির চেয়ে ৫ কিলোমিটার বেশি গতিতে। গুগলি আছড়ে পড়বে ঘণ্টায় ৯৫ কিলোমিটার গতিতে—ক্রিকেটের কোনও ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও ভেবেছে?
তার চেয়েও ভয়ঙ্কর জিজ্ঞাসা মুম্বইয়ের কোনও কোনও ক্রিকেটারের মুখে এ দিন শুনছিলাম। কী হবে যদি এ রকম একটা ডেলিভারি দীনেশ কার্তিকের জন্য ওঁত পেতে থাকে? অসামান্য ব্যাট করছেন কার্তিক। নাইটদের এমন স্থিতি দিয়েছেন যে পাঁড় গৌতম গম্ভীর ভক্তরাও অভিভূত! ১৫ ম্যাচে রান ৪৯০। এত নিচে ব্যাট করেও স্ট্রাইক রেট ১৪৮। গড় ৫৪। কিন্তু এ বার যদি ব্যাটসম্যানের জন্য সেই ভূতুড়ে শব্দটা হাজির হয়—ল অব অ্যাভারেজ? তখন এত কৌশলী আক্রমণের বিরুদ্ধে কে টানবেন নাইটদের? মুম্বই শহরের নানা স্তরেও এটা নিয়ে এমন আলোচনা শুনছিলাম যে মনে হচ্ছিল আইপিএল সত্যি সর্বভারতীয় মাত্র পেয়ে গিয়েছে। এটা কলকাতা ভার্সেস হায়দরাবাদ রনজি ট্রফি সেমিফাইনাল নয় যে নিছক দুটো রাজ্যের মাথাব্যথা।গোটা ভারতীয় ক্রিকেট সার্কিটটাই নিজ নিজ গবেষণা শুরু করেছে। আপাতত সেই গবেষণার ফার্স্ট পেপার— রবিন উথাপ্পা। পারবেন তিনি অন্তত কাল নাইটদের উদ্ধার করতে? রবিনের ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ তাঁর এ বছরের পারফরম্যান্সে হালকা সন্দেহের বিজ দেখছেন— ক্যাপ্টেন করা হল না বলে কি ও মোটিভেশন পাচ্ছে না?
তাঁর নক আউট ম্যাচ পারফরম্যান্স নিয়ে চিরকালীন অবিশ্বাস রয়েছে বলেই এত আগে টিম ইন্ডিয়ায় ঢুকেও ভারতীয় দলে নিয়মিত জায়গা হয়নি। আরও বড় প্রশ্ন থেকেছে অ্যাটিটিউড নিয়েও। নিজের রাজ্য দল কর্নাটক তাঁকে রাখেনি। বাংলার হয়ে খেলতে চেয়েছিলেন, সৌরভ রাজি হননি। সৌরাষ্ট্রে কোনওক্রমে এ বছর ঢুকেছেন। আর সেখানেও তাঁকে নিয়ে পরিস্থিতি সুস্থির নয়। এমতাবস্থায় ভিভো আইপিএল—কেই প্রত্যাবর্তন মঞ্চ হিসেবে রবিনের ধরার কথা। অথচ ভাবভঙ্গিতে কোনও ছাপ নেই। ১৫ ম্যাচে ৩৪৯ রান আর মাত্র ২৩ গড় দিয়ে তাঁকে ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। গোটা হাবেভাবেই যেন ফুটে বার হচ্ছে, আমি কেয়ার করি না। আন্দাজ করছি শুক্রবার দুটোর একটা ঘটবে। কেকেআর হয় তাঁকে তিন নম্বর থেকে আরও পেছোবে। বা রবিন দুর্দান্ত ব্যাট করে দেবেন। কোথাও যেন নিজের ভাবমূর্তি নিয়ে তিনি খাদের কিনারে। আর কে না জানে আইপিএল বড় নিষ্ঠুর। শচীন—রাহুল—লক্ষ্মণকেই পরোয়া করেনি। তো কে রবিন উথাপ্পা!
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পরপর দু’টো ক্রিকেটবোমা পড়েও কোয়ালিফায়ার টু ঘিরে মাদকতা কমেনি। কে জানত, এবি ডে’ভিলিয়ার্সের আচমকা অবসরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জানা যাবে বিরাট কোহলি ইংল্যান্ড ঠিকই যাবেন তবে পিঠের ডাক্তার দেখাতে। সারের হয়ে খেলতে নয়। আর কে জানত যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সার্কিটকে ডুবিয়ে দেওয়া যুগপৎ ট্র্যাজিক হাওয়াতেও ইডেন ম্যাচ ঘিরে চাঞ্চল্য কমবে না!
কারণ আন্দ্রে রাসেল। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান দ্বীপপুঞ্জে নাকি পুওর ম্যানস ক্রিস গেইল নামে পরিচিত। কেকেআর সমর্থকের কাছে আপাতত তিনিই গেইল তিনিই রাসেল। কপিল দেব অবধি মুগ্ধ বিস্ময় বলছিলেন, “ছেলেটা কী মারে ভাবা যায় না।” ব্যাটিং চাঞ্চল্য যদি রাসেল হন। যদি কেকেআর ভক্তের মনে হতে থাকে ফাইনালে টিমকে তুললে তাঁকে পুরসভার সম্মানিক নাগরিকত্ব দেওয়ার সময় হয়েছে তাতে নবীন আবাহনের তীব্রতা কমছে না। শুভমান গিলের পর এ বার তিনি প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ। প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ নামেই কর্নাটক। আসলে মুম্বইয়ের প্রাক্তন এবং কেকেআর মেন্টর অভিষেক নায়ারের প্রিয় ছাত্র। বান্দ্রায় অভিষেকের একত্রিশ তলার ফ্ল্যাটে অর্ধেক সময় এই পেসারকে পাওয়া যায়। যিনি গ্রেগ চ্যাপেলের পরিচালিত ব্রিসবেন অ্যাকাডেমিতে গিয়ে নাকল বলের ব্যবহার আরও ক্ষুরধার করেছেন। ওদের যদি ভুবি থাকে আমাদের আছে কৃষ্ণ। নাইট সমর্থককে আপাতত ডরায় কে? আর তারা শুধুই বাঙালি বললে বুঝব আইপিএলের মাহাত্ম্য সম্পর্কে আপনি এখনও অবগত নন!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.