দীপ দাশগুপ্ত:
সংক্ষিপ্ত স্কোর : ভারত : ২৭৪-৭ (রোহিত ১১৫, কোহলি ৩৬, এনগিডি ৪/৫১), দক্ষিণ আফ্রিকা : ২০১ (আমলা ৭১, কুলদীপ ৪/৫৭, পাণ্ডিয়া ২/৩০, চাহাল ২/৪৩)
বিরাট কোহলির দলটা অন্য রকম। ভারতীয় ক্রিকেটে অনেক বড় বড় দল এসেছে। কিন্তু এই দলটা অন্য টাইপ। এক্স ফ্যাক্টর আছে। বিরাটের দল নিয়ে এত দিনের বলা কথাগুলোর ওপরে ২০১৮-র ১৩ ফেব্রুয়ারি সিলমোহর পড়ল! আমি অন্তত সেরকমই মনে করি।
আমরা ইংল্যান্ডে সিরিজ জিতেছি। অস্ট্রেলিয়ায় জিতেছি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে জিতেছি। পাকিস্তানে জিতেছি। ক্রিকেট মানচিত্রে এই একটা ভূখণ্ড-ই বাকি ছিল, যেখান থেকে ভারতীয় দল কখনও কোনও সিরিজ জিতে ফেরেনি। টেস্ট, ওয়ান ডে কিচ্ছু নয়। সাধে কী আর এবার ভারতের দক্ষিণ আফ্রিকা ট্যুরের অনেক আগে থেকে টিভি প্রোমোর ক্যাচলাইন ছিল- ‘পঁচচিশ সাল কা বদলা!’ সেই ১৯৯২ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করছে ভারত। কিন্তু মঙ্গলবারই ম্যান্ডেলার দেশের মাটিতে প্রথম কোনও সিরিজ জিতল ভারতীয় ক্রিকেট দল।
এবং কী দুর্ধর্ষ ভাবেই না জিতল! প্রথমে টেস্টে ০-২ পিছিয়ে সিরিজ খোয়ালেও শেষ টেস্টে দুরন্ত ক্যামব্যাক করে জিতে সম্মানজনক ১-২’এ সিরিজ শেষ করা। তারপর ওয়ান ডে-তে ৪-১ এগিয়ে এক ম্যাচ বাকি থাকতেই সিরিজ পকেটে পুরে ফেলল বিরাটরা। প্রথম তিনটে ম্যাচই জেতার পর গত ম্যাচে জো’বার্গে যেটা ভারতীয়রা হেরেছিল, সেটা বৃষ্টিতে দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসে জাস্ট টি-টোয়েন্টিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
এদিন ফিফথ ওয়ান ডে-তে আবার একটা একশো ওভারের ম্যাচ হল আর ভারত ৭৩ রানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে ঐতিহাসিক সিরিজ জিতল। যে জয়ের পিছনে ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে বসে সবার আগে আমার মনে পড়ছে হার্দিক পাণ্ডিয়ার নাম। আর তারপরই ক্যাপ্টেন কোহলি নামটা।
দেখুন, অন্য যে কোনও দিন হলে দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসের এগারো ওভারে কোহলি ফার্স্ট চেঞ্জে নিয়ে আসত স্পিনারকে। বিশেষ করে যখন এই ওয়ান ডে সিরিজে কুলদীপ-চাহাল জুটির পারফরম্যান্স অসাধারণ। আগের ম্যাচে আমাদের রিস্ট স্পিনার জুটি যে মার খেয়েছিল ওটাকে ধরবেন না। সেদিন তখন কুড়ি ওভারের ক্রিকেট হচ্ছিল। পোর্ট এলিজাবেথে পাণ্ডিয়া শুধু ক্যাপ্টেনের কল-এ সাড়া দিয়ে ভাল বোলিং-ই করল না। বলটা মাথা দিয়ে করেছে। জোরের চেয়ে স্লো ডেলিভারি দিয়েছে অনেক বেশি।
এদিনের উইকেটে টস জিতে দু’দলের অধিনায়কই আগে বল করতে চেয়েছিল। কারণ পিচটা ছিল খেলা যত গড়াবে ততই স্লো হয়ে পড়বে গোছের পিচ। সেজন্য তুমি যদি ফ্লাডলাইটে পরে ব্যাট করো, তাহলে ব্রেকে পিচে রোলিং, রাতের ঠান্ডা কন্ডিশন মিলেজুলে কিছুটা বাড়তি জমাট উইকেট পাবে। যেখানে বল ইনিংসের গোড়ার দিকে ভাল ক্যারি করবে। আমলা-ডুমিনি-এবিডি’রা সেটা পেয়েছিল। কিন্তু হার্দিকের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং সেই সুবিধেটা দক্ষিণ আফ্রিকান টপ অর্ডারকে নিতে দেয়নি। মনে করে দেখুন, ওদের তিন সেরা ব্যাটসম্যান-ই হার্দিকের শিকার। নিজের প্রথম দু’ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই সেরা ব্যাটসম্যান ডুমিনি (১) আর এবি ডে’ভিলিয়ার্স-কে (৬) আউট তো করলই। ইনিংসের মিডল ওভার্সে যখন আমলাকে (৯২ বলে ৭১) দারুণ জমাট আর ক্রমেই বিপজ্জনক দেখাতে শুরু করেছে, ঠিক সেসময় মিড অন থেকে নন স্ট্রাইকার এন্ডে ডাইরেক্ট থ্রোয়ে অনবদ্য রান আউট করল তাকে। দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্স হার্দিকের! সবচেয়ে বড় কথা, ভুবনেশ্বর-বুমরার ২০ ওভার পেস বোলিং আর কুলদীপ-চাহালের ২০ ওভার স্পিন-এই ৪০ ওভার নিয়ে চিন্তা ছিল না কোহলির। প্রশ্ন ছিল, তিনশোর কম তাড়া করতে নামা এবিডিদের বিরুদ্ধে ভারতের ফিফথ বোলারের অপশনটা কে মেটাবে? হার্দিক সেটা শুধু মেটায়নি। অসাধারণ ভাবে মিটিয়েছে।
[ ট্রেনের শৌচাগারের সামনে বসে ঢুলছে আইজলের খুদে ফুটবলাররা, ভাইরাল ছবি ]
আবার দেখুন, আমলার রান আউটের পর যখন চাপে পড়ে যাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসে নতুন ব্যাটসম্যান ক্রিজে এলো, সঙ্গে সঙ্গে কোহলি কুলদীপকে আক্রমণে এনেছে। আর কুলদীপের চায়নাম্যান রহস্যের কুলকিনারা পায়নি ফেলুকায়ো, ক্লাসেন, রাবাদারা। পারফেক্ট ক্যাপ্টেন্সি কোহলির। কোহলির ভারতের সবচেয়ে বড় গুণ, যা সিদ্ধান্ত নেয় সেটাকে ‘ব্যাক’ করে। সিদ্ধান্তাটা রেজাল্ট না দিলেও ‘ব্যাক’ করে। ব্যর্থ হলে বলে না যে, আহা, অমুকটা না করে তমুকটা করলে বোধহয় ভাল করতাম। আর যাকে দলে রাখে তার ওপর পুরো আস্থা রাখে। সেই ক্রিকেটার কয়েকটা ম্যাচে ভাল করতে না পারলেও তাকে সরায় না। এদিনই রোহিত শর্মার সেঞ্চুরি যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
কিন্তু এটাও ঠিক, জো’বার্গের মতো পোর্ট এলিজাবেথেও ভারতের শেষ দশ ওভার ব্যাটিং খারাপ হল। এদিনেরটাকে তো বেশ খারাপ বলা যায়। আগের ওয়ান ডে-টার মতো মঙ্গলবারও ৪০ ওভার শেষে ভারতের বোর্ড দেখে মনে হচ্ছিল, ৩২০ না হলেও মিনিমাম তিনশো হবেই। সেখানে ভারত চতুর্থ ম্যাচের মতো ফিফথ ওয়ান ডে-তেও ২৫-৩০ রান কম তুলেছে।
এদিন ৪০ ওভারে ভারতের রান ছিল ২১৯/৩। রোহিত ১১০ ব্যাটিং। মানে ক্রিজে একদম সেট আর একশো পার করে সম্পূর্ণ রিল্যাক্সড। আর রোহিতের ওয়ান ডে ব্যাটিং স্টাইলটাই হল, এরকম জায়গা থেকেই ও নিজের সেই অসাধারণ খেলাটা খেলতে শুরু করে। সেই সব অবিশ্বাস্য বিগ হিট নেয় যার জন্য ও এই ফরম্যাটে বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। হিটম্যান। দেখবেন, রোহিত হয়তো সেঞ্চুরি করে একশো বা তার একটু কম স্ট্রাইক রেটে। কিন্তু সেঞ্চুরির পর থেকে ওর স্ট্রাইক রেট এমন চড়চড় করে বাড়তে থাকে, যখন আউট হয় বা নটআউট থেকে ডাগআউটে ফেরে দেখা যায় ওর টোট্যাল স্ট্রাইকরেট ১৪০-১৫০! তাছাড়া রোহিতের ১৭টা ওয়ান ডে সেঞ্চুরির মধ্যে ১৩টায় ও ১২০ বা তার বেশি রান করেছে। সেদিক দিয়ে এই ম্যাচে সেঞ্চুরিয়ান রোহিতের (১২৬ বলে ১১৫) থেকে ওর দু’টো ইউএসপি-ই বাদ পড়েছে। বড় সেঞ্চুরি যেমন শেষমেশ আসেনি। তেমনি দুর্ধর্ষ স্ট্রাইকরেটও ছিল না। ৫০ ওভারে ভারতের তিনশো কেন, পৌনে তিনশোতেও পৌঁছতে না পারার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই।
[ ব্যাটেই জবাব নিন্দুকদের, ব্যর্থতা ঝেড়ে কেরিয়ারের ১৭তম সেঞ্চুরি রোহিতের ]
রোহিতের ৯৬-এর মাথায় শামসির হাতে ক্যাচ তুলে বেঁচে যাওয়াটা আমার কাছে বিরাট ব্যাপার নয়। ওয়ান ডে-তে রানের পিছনে ছুটতে গেলে এরকম খুচখাচ ক্যাচ ব্যাটসম্যান তুলতেই পারে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার, ভারতের ইনিংসের বিজনেস এন্ডে রোহিতের আউট হয়ে যাওয়াটা। ৪৩তম ওভারে দলের ২৩৬ রানে আউট হয়েছে রোহিত। ও পুরো ৫০ ওভার থাকলেই ভারত হাসতে হাসতে ৩০০—৩২০’তে পৌছে যেত।
আসলে ওয়ান ডে-তে যে কোনও দলের শেষ দশ ওভারে ১০০—১১০ রান তোলার জন্য একজন সেট ব্যাটসম্যানের ক্রিজে থাকাটা মাস্ট। যে তার আগে অন্তত ২৫-৩০ ওভার খেলে ফেলেছে। ওপেনার হলে তো আরওই ভাল। তার মানে সেই সেট ব্যাটসম্যানের ৪০ ওভার খেলা হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় ইনিংসে এদিন ঠিক একদম সেই সুযোগটাই থাকলেও কাজে লাগানো যায়নি। রোহিত আউট হয়ে যাওয়ায় এদিন আরও কী হয়েছিল, নতুন ব্যাটসম্যানকে ক্রিজে এসেই রানের পিছনে ছুটতে হল। হার্দিক পাণ্ডিয়ার (০) প্রথম বলেই আউট হওয়ার পিছনে আমার মতে কারণ সেটাই। শ্রেয়স (৩৭ বলে ৩০) খানিকটা চেষ্টা চালালেও ও ইনিংসের শেষ পাঁচ ওভার আসার আগেই আউট হয়ে যায়। ফলে ভারতের ইনিংসের একদম স্লগে ক্রিজের দু’দিকেই নতুন ব্যাটসম্যান হয়ে গেল। সেটা কখনও ধোনি—ভুবনেশ্বর। কখনও ভুবি-কুলদীপ। যাদের ক্রিজে এসেই প্রথম বল থেকে বড় শট নিতে হত। যেটা পারেনি।
[ এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি পর্বে সোনা জিতে নজির গড়লেন বাংলার সোনিয়া ]
শেষ দশ ওভারে এদিন ভারত ৫৫ রান তুলেছে। পাঁচ উইকেট হারিয়ে। তারপরেও অবশ্য মিডল অর্ডারকে পুরোপুরি দায়ী করতে পারছি না। ওই যে বললাম, একজন ভালরকম সেট ব্যাটসম্যানকে ওই সময় দরকার ছিল ক্রিজে। তাহলেই ছবিটা পাল্টে যেত। হতে পারে, ওই সময় পাঁচটা উইকেটের মধ্যে চারটেই নিয়েছে এনগিডি। দক্ষিণ আফ্রিকান পেসারের কৃতিত্বকে এতটুকু ছোট না করেও বলব, পাণ্ডিয়ার আউটের বলটা বাদে বাকি উইকেটগুলো ব্যাটসম্যানরা ওই পরিস্থিতিতে বড় শট খেলতে গিয়ে বোলারকে দিয়েছে।
রোহিত সেঞ্চুরি করল অথচ এতক্ষণ ওকে নিয়ে বেশি নেগেটিভ—ই লিখলাম। অনেক আগেই আমার লেখা উচিত ছিল, রোহিতের ব্যাটিংয়ে এদিন যেটা সবচেয়ে দেখে ভাল লাগছিল সেটা হল, কোন বলটা কীভাবে খেলবে সেই ব্যাপারে একদম সিওর হয়ে খেলার ব্যাপারটা। শেষ দু’টো ম্যাচে ও বড় রান পায়নি। কিছুটা দোনামেনা হয়ে খেলেছিল। কয়েকটা ম্যাচে বড় রান না পেলে এটা যে কোনও ব্যাটসম্যানেরই হয়। কিন্তু এদিন রোহিত যেন ঠিকই করে নেমেছিল, মারার বল মারবেই। ডিফেন্স করার বল ডিফেন্স-ই করবে। যে জন্যই ওকে এদিন আগাগোড়া জমাট আর নিজের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাসী দেখিয়েছে ব্যাট হাতে।
আর কী আশ্চর্য! ভারতের ব্যাটিং নিয়ে এতক্ষণের লেখাতেও একবারও বিরাটের কথা আসেনি। বিরাট কোহলি (৫৪ বলে ৩৬) একদম ওর ওয়ান ডে ব্যাটিং স্টাইলেই এদিনও নিজের ইনিংসের ভিত গড়ে ফেলেছিল। সেই শুরুর দিকে ফিল্ডারের ফাঁক খুঁজে পুশ করে সিঙ্গলস, টু’জ নেওয়া। লুজ বল পেলে একদম সিওর বাউন্ডারি পাওয়া যাবে বুঝলে তবেই বড় শট নেওয়া। সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু যে সিঙ্গলস আদৌ ছিল না, সেটাই স্ট্রাইকার রোহিত আর তার চেয়েও বেশি করে নন-স্ট্রাইকার বিরাট নিতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনল। এবং বিরাট আউট। রান আউট। আর বিরাট কোহলি ৩৭-এ রান আউট হলে কোন ম্যাচ রিপোর্টে আর বেশি লেখা হয়?
[ অঙ্কিতের স্মৃতি ফিরল নবদ্বীপে, মাথায় বল লেগে মৃত্যু দৃষ্টিহীন ক্রিকেটারের ]
ম্যাচ শেষে কী বললেন রোহিত, দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.