ক্রিকেটে যদি হন মহেন্দ্র সিং ধোনি, ফুটবলে তাহলে সুনীল ছেত্রী (Sunil Chhetri)। তাঁকে ফোনে পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। সোমবার দুপুরে যখন তাঁর স্ত্রী সোনমকে ফোনে পাওয়া গেল, তখন সুনীলের ভুবনেশ্বর থেকে বেঙ্গালুরুর বিমানে ছাড়বে ছাড়বে করছে। আর সন্ধ্যা ৬.০৪-এ সুনীল যখন ফোন করলেন, আমি তখন বেঙ্গালুরু যাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে বিমানে উঠেছি। ফলে ইন্টারভিউটা নেওয়ার সুযোগ পেলেও নেওয়ার উপায় নেই। কপালের দোষ বলে মানসিক শান্তি পাওয়া ছাড়া আর কীই বা করার থাকতে পারে? সোনার পাথরবাটির মতোই আশ্চর্যরকমভাবে সুনীলের টেক্সট এল একটু বেশি রাতে। ‘কাল সকাল সাড়ে এগারোটায় কল করুন।’ যথারীতি এদিন সকালে কল করে ফের ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। আধঘন্টা পরে বার্তা পাঠালেন, ‘টিম মিটিং থেকে ফ্রি হয়েই কথা বলছি।’ অবশেষে ভারতীয় ফুটবলের হার্টথ্রব ধরা দিলেন সংবাদ প্রতিদিন-এর কাছে। আর শুধু ধরাই দিলেন না, মনের ঝাঁপি উজাড় করে দিলেন। শুনলেন দুলাল দে।
খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, ডাগ আউটে গিয়ে স্ত্রী সোনমকে ক্যাপ্টেন্সির আর্মব্যান্ডটা পরিয়ে দিলেন?
সুনীল: (হেসে) তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল ওটা। মাঠের বাইরে সোনম-ই তো আমার ক্যাপ্টেন। ওর ক্যাপ্টেন্সিতেই এগিয়ে চলেছি। (ফের হাসি) তাই আমার হাত থেকে খুলে ওর হাতে পরিয়ে দিলাম।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে গোল করে অভিনব উপায়ে বাবা হতে চলার সংবাদটা সবাইকে দেওয়ার পরিকল্পনাটা কার? আপনার না সোনমের?
সুনীল: যেদিন জানতে পারলাম, আমাদের সন্তান আসছে, সেদিনই আমরা আলোচনা করি, এই সুখের খবরটা দেশবাসীকে কিভাবে জানাব? একটা সময় মনে হল, সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়ে দিই। কিন্তু সোনম বলল, আমি যেহেতু একজন ফুটবলার, তাই ফুটবলের ভাষাতেই দেশবাসীকে খবরটা আমরা দেব। কারণ এর আগে বহু ফুটবলার মাঠের মধ্যে তাঁদের সন্তান হওয়ার খবর দিয়েছে। বিশ্বকাপে গোল করে বেবেতোর সেই ডান্সটা মনে করুন। তখনই আমরা আলোচনা করে ঠিক করি, গোল করেই ঠিক এই স্টাইলে সারা দেশকে জানিয়ে দেব, আমাদের সন্তান আসতে চলেছে। ইন্টার কন্টনেন্টাল কাপ শুরু হওয়ার আগে থেকেই তাই সেলিব্রেশনের মানসিক প্রস্তুতিটা ছিল।
ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে প্রথম ট্রফি জয়, প্রথম গোল করার অনুভূতি, সেই প্যাশন, এখনও কি সমান ভাবে থাকে? না কি কখনও কখনও মনে হয়, জাস্ট ডিউটি করছেন? দেশের হয়ে খেললে গোল করা, দেশকে জেতানোটা ডিউটি। ব্যস এটুকুই?
সুনীল: আপনি যেহেতু আমাকে ফুটবল কেরিয়ারের একদম প্রথম থেকে খুব কাছের থেকে লক্ষ্য করছেন,তাই হয়তো এরকম মনে হচ্ছে। শুধু আপনিই নন, আমার বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠও একই কথা বলছিলেন, আমাকে না কি, বেশ কিছু মুহূর্তে খুব আবেগহীন অবস্থায় দেখা গিয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, জাতীয় দলের হয়ে খেলার প্যাশনটা এতটুকু কমেনি। তাহলে খেলতে পারতাম না। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে প্রথম ম্যাচটা যে প্যাশন নিয়ে খেলেছি, এখনও সেই প্যাশনটাই রয়েছে। যেটা বদলেছে, সেটা হল, উচ্ছ্বাস প্রকাশের ভাষা। একজন বাচ্চা ছেলে গোল করার আনন্দে যে ভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারে, ফুটবল কেরিয়ারের সায়াহ্নে এসে আমি ঠিক সেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারি না। আনন্দে উচ্ছ্বাস প্রকাশ আমারও থাকে। তবে সেটা অন্যভাবে। আর এটাতেই হয়তো অনেকের মনে হয়েছে, প্যাশন কমে শুধুই ডিউটি পালন করছি। কিন্তু সেটা আদতে উল্টো।
ফুটবল কেরিয়ারের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে কোথাও কী আক্ষেপ হয় যে, ভারতে না জন্মে ইউরোপের কোনও ছোট্ট দেশে জন্মালে হয়তো বিশ্বকাপটা খেলতে পারতেন?
সুনীল: বিশ্বাস করুন, একদম নয়। বরং নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। আপনি তো আমাকে জাতীয় দলে শুরুর দিন থেকে দেখেছেন, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, তখন বুঝতে পেরেছিলেন, এতদিন, এত ম্যাচ, এত গোল আমার নামের পাশে থাকবে? কাউকে ছোট করছি না। কিন্তু ফুটবল খেলে সারা দেশের মানুষের এরকম পর্যায়ের ভালবাসা আমার আগে আর কতজন ফুটবলার পেয়েছেন বলুন তো? এই দেশেই ফুটবল খেলে নাম-যশ-অর্থ সব পেয়েছি। একদম হৃদয় থেকে বলছি, আমার জীবনে কোনও আক্ষেপ নেই। অন্য দেশে জন্মালে বিশ্বকাপ খেলতে পারতাম, কখনওই ভাবি না। বরং ভাবি, আমার দেশ একদিন ঠিক বিশ্বকাপ খেলবে।
পর্তুগালে গেলেন। এখন কি মনে হয়, আরও কিছুদিন মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে ভাল হত?
সুনীল: ঠিক এই জায়গাটা নিয়ে আমার মনে এখনও একটা খচ খচ লেগে আছে। এটাকে ঠিক আক্ষেপ বলব না। আসলে আমি যখন পর্তুগালে গিয়েছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল ২৪। এখন ফিল করি, আমার ১৫-১৬ বছর বয়সে পর্তুগালে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখন একজন জুনিয়র ফুটবলারের সামনে যে সুযোগ আছে, আমার ১৫-১৬ বছরে সেই সুযোগটাই তো ছিল না। তখন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলে খেলতে পারাটাই তো একজন ফুটবলারের স্বপ্ন ছিল। এখন বুঝি, ছোট বয়সে ইউরোপের ফুটবল পরিকাঠামোয় বড় হতে পারলে, ব্যপারটা আরও একটু অন্যরকম হত।
জাতীয় দলে একের পর এক স্ট্রাইকিং পার্টনার পরিবর্তন হয়ে গেল। একসময় বাইচুং ভাই। পরে জেজে। তারপর রবিন সিংরা এলেন। এখন সাহাল-আশিকের মতো জুনিয়ররা। পার্টনারের নাম বদলে গিয়েছে। থেকে গিয়েছে শুধু একটাই নাম, সুনীল ছেত্রী।
সুনীল: (হেসে) আপনাদের সকলের আশীর্ব্বাদ বলতে পারেন। প্রতিটা দিন ভাবি, আমি নিজের একশো শতাংশ সততার সঙ্গে দিচ্ছি তো? দিনের শেষ আমার হৃদয় যদি বলে, আজ প্র্যাকটিসে নিজেকে ঠকাইনি। তাহলে আমি ঠিক আছি। এটুকুই আমার নিয়ন্ত্রণে। বাকি যে যে জিনিসটার উপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই, তা নিয়ে ভাবিও না।
আচ্ছা, অনিরুধ থাপা, সাহাল, আশিক, ছাংতেরা টিম হোটেলে আপনার সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারেন? ওদের মধ্যে কারও কারও আদর্শ আপনি। সহজ ভাবে আড্ডা দেওয়া যায়?
সুনীল: সত্যি বলতে সমস্যা তো একটু হয়ই। ওরা আমার থেকে এতটাই ছোট যে, আড্ডা-ইয়ার্কি কোনওটাই করা সম্ভব হয় না। আমি যাদের সঙ্গে খেলেছি, সেই মহেশ ভাই, রেনেডি ভাই সবাই এখন কোচিং করছে। এই দলে আমি একটা নিজের ছোট্ট গ্রুপ বানিয়ে ফেলেছি। সন্দেশ, গুরপ্রীত, বোর্জেস এরাও আমার থেকে অনেকটাই ছোট। তবুও এদের সঙ্গে ইয়ার্কি-ঠাট্টা চলে। ছোটদের সঙ্গে আড্ডা মারা থেকে নিজেদের একটু গুটিয়ে রাখি। কারণ, আমি ওদের আড্ডায় চলে গেলে, ওরা খেলার বাইরে আড্ডায় নিজেদের রিল্যাক্স রাখতে পারবে না।
সুনীল ছেত্রী পরবর্তী ভারতীয় ফুটবলে স্ট্রাইকার পজিশনে এখন এতটাই খরা যে, স্থানীয় লিগে বিদেশি বাদ দিয়ে ভারতীয় ফুটবলারদের সংরক্ষণ করতে হচ্ছে।
সুনীল: ফেডারেশনের এই সিদ্ধান্তে আমি একশো ভাগ সমর্থন করছি। আইএসএল-আই লিগে মনবীররা বিদেশি স্ট্রাইকারদের সঙ্গে লড়াই করুক না। কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু লোকাল লিগে আমাদের দেশের জুনিয়র ফুটবলারদের খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। লোকাল লিগেও যদি বিদেশিরাই খেলে, তাহলে আমাদের পরের জেনারেশন তৈরি হবে কী করে?
যখন মোহনবাগানে খেলা শুরু করেছিলেন, বলতে গেলে সেই সময় সেভাবে অর্থই পাননি। আর আজ আইএসএলের দৌলতে প্রথম বছর খেলার সুযোগ পাওয়া ছেলেটিও হয়তো কোটি টাকা রোজগার করে। কখনও মনে হয়, ফুটবল কেরিয়ারটা এই সময় শুরু হলে ভাল হত?
সুনীল: আমার কিন্তু একবারও মনে হয় না। আগেই বলেছি, ফুটবল খেলে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। ফুটবল কেরিয়ারে আমি যা পেয়েছি, সন্তুষ্ট। তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। এখন অন্যরকম। (হেসে উঠে) যা অর্থ রোজগার করেছি, ঠিক আছি।
আমরা যাঁরা আপনার কেরিয়ারের শুরু থেকে দেখছি, চোখের সামনে দেখলাম, কেমন বদলে গেলেন। আধা প্রফেশনাল থেকে চূড়ান্ত প্রফেশনাল হয়ে উঠলেন। ভারতীয় ফুটবলকে ঘিরে প্যাশনটাও কি আগের থেকে অনেকটাই বদলে গিয়েছে?
সুনীল: যা হয়েছে, ভালই তো হয়েছে। আগে ফুটবল নিয়ে দু’একটি রাজ্যে উন্মাদনা ছিল। এখন সেখানে মোটামুটিভাবে সারা দেশে। জাতীয় দল নিয়ে দেশের ইয়ং ব্যাচ মারাত্মক অ্যাক্টিভ। জাতীয় দল নিয়ে এত সচেতনতা আগে ছিল না। এর সঙ্গে ফুটবলে এখন প্রচুর টাকা আসছে। আগে ফুটবলাররা খেলতো। সঙ্গে চাকরি করত। এখন খেলাটাই পেশা হয়ে গিয়েছে। যে যে রাজ্যে ফুটবল নিয়ে আগের থেকে প্যাশন কমছে, সেটা সেই রাজ্যের ফুটবল সংস্থার দোষ। ভালভাবে লোকাল ট্যালেন্ট তুলে আনতে পারছে না বলে প্যাশন কমছে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে দেশজুড়ে ফুটবলের প্রতি প্যাশন বেড়েছে।
বুধবার প্রথম ম্যাচেই প্রতিপক্ষ পাকিস্তান?
সুনীল: সুখী স্যরের কোচিংয়ে জাতীয় দলে আমার অভিষেক হয়েছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই। তাও আবার পাকিস্তানের মাটিতে। তাই আমার জন্য নতুন কোনও অভিজ্ঞতা নয়। আচ্ছা, বাকি কথা কাল ম্যাচের পর।
এই অনুরোধের পর আর কথা বাড়ানো যায় না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.