স্বামী নীরঞ্জয়কে নিয়ে চাষের কাজে ব্যস্ত কবিতা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট সানি। ছবি: অমিত মৌলিক।
প্রসূন বিশ্বাস: হরিপাল স্টেশন থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে হিজলি গ্রামে যখন পৌঁছলাম, সেই সাতসকালে তাঁকে পাওয়া গেল গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে সবুজ জমিতে। আলু চাষ করতে ব্যস্ত। কোদাল নিয়ে স্বামীর পাশে মাটি কোপাচ্ছেন ছোট্টখাট্টো কৃষতনু মেয়েটি। একটু দূরে খেলা করছে তাঁদের আড়াই বছরের ছোট্ট ছেলে সানি। কে বলবে কবিতা সোরেন (Kabita Saren) নামের এই সাঁওতাল মহিলা ফুটবলার কন্যাশ্রী কাপে (Kanyashree Cup) শ্রীভূমি এফসি-র (Srebhumi FC) হয়ে এবছর দাপটের সঙ্গে আট-আটটা গোল করেছেন! গতবছর করেছিলেন নয় গোল, সেটা অবশ্য ইস্টবেঙ্গল (East Bengal) জার্সি গায়ে। টানা দু’বছর দুই ক্লাবের জার্সিতেই কন্যাশ্রী কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কবিতা।
একজন অজগ্রামের সাঁওতাল গৃহবধূ হয়েও হাজার এক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে কলকাতা মাঠে পৌঁছনোটা এত সহজ ছিল না। তার উপর বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর গ্রামের অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি তাঁর ফুটবল খেলাটাকে। এখন হরিপালের হিজলির সেই মেয়েই মন জয় করে নিয়েছে কলকাতা ময়দানের। শুধু তাই নয়, কন্যাশ্রী কাপে খেলে কবিতা যে অর্থ পান তিনি, সেই অর্থ দিয়ে জমি চাষের বীজ কেনেন। স্বামীকে চাষের খরচ জোগান দেন। নিজেদের জমি নেই। স্বামী নীরঞ্জয় মুর্মু অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষ করছেন। সেই অল্প জমিতেই এবার আলুর ফলন ধরিয়েছেন কবিতারা।
কবিতা সদ্য চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কন্যাশ্রী কাপ। হাতে কিছু সময় পেয়েছেন। তাই ভালো করে চাষের কাজে নেমে পড়েছেন কবিতা আর নীরঞ্জয়। গ্রামের মানুষ এখন আর কিছু বলেন না। তবে সাঁওতাল গৃহবধূ ঘর থেকে বেরিয়ে ভোর তিনটের সময় কলকাতা ছুটে গিয়ে ফুটবলে লাথি মারবে, তা একটা সময় মেনে নেননি পাড়া-প্রতিবেশীরা। বিয়ের পর নিজের শাশুড়ি পূর্ণিমা মুর্মুই প্রথম বাধা দিয়েছিলেন। এখন সেই শাশুড়িই তাঁর অবর্তমানে কবিতার আড়াই বছরের ছোট্ট ছেলে সানিকে রেখে দেন নিজের কাছে। পূর্ণিমা বলছিলেন, “বউমা যখন প্রথম খেলতে যাবে বলেছিল তখন বলেছিলাম ঘরের বউ কেন যাবে। তখন ও বলেছিল আমাকে খেলতে না দিলে আমি থাকব না। আজ বুঝেছি খেলা ছাড়া বাঁচবে না। আমার ছেলেও বুঝিয়েছে। তাই এখন আর কিছু বলি না।”
আলুর জমিতে কোদাল চালাতে চালাতেই কবিতা বলেন, “অনেক বাধা টপকে আজ এই জায়গায় এসেছি। কন্যাশ্রী কাপ ছিল বলে এত পরিচিতি পেয়েছি। এবার যদি একটা চাকরি পাই তাহলে খেলাটা চালিয়ে যেতে পারি। আমাদের নিজের জমি নেই। এটা অন্যের জমি। টাকা নেই বলে মজুর রাখি না। নীরঞ্জয় আর আমি মিলে চাষের পুরো কাজটা করি। অনেক কষ্ট করে এগিয়েছি।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন কবিতা। তারপর জমি থেকে উঠে এসে পাশের এক মনসাতলায় বসে আরও বললেন, “কন্যাশ্রী কাপে নিজেকে প্রমাণ করেছি, এবার আইডব্লুএলে নিজেকে প্রমাণ করতে চাই। ইচ্ছা আছে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানোর।”
শুধু সময় বদল নয়, এক সময় যে প্রতিবেশীরা তাঁর এই ফুটবল খেলাকে নিয়ে নিন্দা করতেন, এখন হরিপালের অজ গ্রামের কবিতাই এখানকার মেয়েদের রোল মডেল। পাশের গ্রামের মেয়েরা গ্রামের স্কুল মাঠে মেয়েদের ফুটবল খেলতে পাঠায়। তারাও স্বপ্ন দেখে কবিতার মতো ফুটবলার হওয়ার। তবে কবিতার এই লড়াইয়ের পিছনে যে মানুষটা বটবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তিনি কবিতার স্বামী নীরঞ্জয়। নিজে একটা সময় সাইয়ের আবাসিক ফুটবলার ছিলেন। ফুটবলার হতে পারেননি। কবিতার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর নীরঞ্জয় তাঁকে কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতায় ফুটবল খেলতে পাঠান। আজ স্ত্রীর সাফল্যের দিনে আপ্লুত নীরঞ্জয় বলেন, “অনেক বাধা টপকে আজ এই জায়গায় পৌঁছে সবার সমালোচনা বন্ধ করতে পেরেছি। আমি চাই ও ফুটবলটা যেন না ছাড়ে। তাহলে আমাদের গ্রামে এমন আরও অনেক কবিতা উঠে আসবে। সমাজে পরিচিতি পাবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে।”
গত বছর কন্যাশ্রী কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর যখন ইস্টবেঙ্গল ফুটবলাররা উল্লাসে ব্যস্ত। কিশোরভারতী স্টেডিয়ামে সেদিন সেই উল্লাসকে উপেক্ষা করে লাল-হলুদ দলের অন্যতম সদস্য কবিতা ছুটে গিয়েছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীর কাছে। কারণ, নিরঞ্জয়ের কোলে তখন ছিল তার ছোট্ট সানি। জয়ের উল্লাসকে ছাপিয়ে মা কবিতা কোলে তুলে নিয়েছিলেন সানিকে। এবারও শ্রীভূমি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও দেখা গিয়েছে সেই দৃশ্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.