সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: বাবা রাঁধুনি আর মা দিনমজুর। জঙ্গলমহল পুরুলিয়ার জয়পুরের অজ পাড়া-গাঁ খেদাটাঁড়ার ‘কন্যাশ্রী’ শীলা বাগদি পৌঁছে গিয়েছে সাগরপাড়ে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে। সোমবার সেখানেই একটি পাঁচতারা হোটেলে সে বলবে বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক যন্ত্রণার কথা। বলবে ওই অবস্থায় নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে নারীর ক্ষমতায়ণে ভবিষ্যৎ গড়া যায়। সেই লড়াইয়ের কথাই শুনবেন ক্রিকেটার যুবরাজ সিং।
[পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ে, থানায় ফুলশয্যা নবদম্পতির]
নতুন বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে নিউজিল্যান্ডে বসছে আইসিসি অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর। সেই মেগা ইভেন্টেরই অঙ্গ হিসাবে কলম্বোয় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেছে ইউনাইটেড নেশনস চিলড্রেন্স ফান্ড বা ইউনিসেফ-এর দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক বিভাগ ও ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা আইসিসি। সেই বিশ্বকাপের প্রচারেই জঙ্গলমহলের ১৪ বছরের কিশোরী শীলা বোঝাবে, কীভাবে প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা হয়েও ফুটবল পায়ে কন্যাশ্রী ক্লাবের স্কুল টিমকে নেতৃত্ব দেওয়া যায়। সে বলবে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরনো’র সংসারে অর্ধাহারে থেকেও লক্ষ্য স্থির রেখে ফুটবলকে পাঠানো যায় জালে।
খেদাটাঁড়ায় শীলাদের ছোট্ট মাটির ঘরে নেই কোনও টিভি। ফলে বাইচুং ভুটিয়া বা লিওনেল মেসির নামও জানা নেই তার। সে জানে না ফুটবলকে ঘিরে এক মস্ত গ্ল্যামার দুনিয়ার কথাও। আজ থেকে বছর ছয়েক আগে কুঁড়েঘরের ছোট্ট জানালা থেকে দেখেছিল একটি বড় বলকে নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একদল ছেলে। কিন্তু এই খেলায় কোনও মেয়ে অংশ নিচ্ছে না। বলকে পায়ে পায়ে বড় জালে ঢোকাতে পাড়লেই বিজয়োল্লাসে মাতছে সবাই। এই ছবিটা মনে গেঁথে যায় নবম শ্রেণির ছাত্রী শীলার। তাই গ্রামের ক্লাবের দাদাদের কাছে একটা ফুটবল চেয়েছিল সে। কিন্তু কিশোরীর এমন ফুটবল খেলায় উৎসাহ দেখে প্রশাংস দূর অস্ত, তাকে শুনতে হয়েছিল ‘মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলবি কী করে?’ তারপরই সে টিফিনের ও বই-খাতা কেনার খরচ কিছুটা বাঁচিয়ে জয়পুর ব্লক সদর থেকে একটি ফুটবল কেনে শীলা। জার্সি ও শর্ট প্যান্ট পরে সকাল-বিকেল বল পায়ে কঠোর অনুশীলনে মেতে ওঠে সে। যা দেখে সেদিন ব্যঙ্গ ও বক্রোক্তি করতে ছাড়েননি অনেকেই। কিন্তু এসবকে গুরুত্ব দেয়নি শীলা। এগুলিকে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স মনে করে তা ভেঙে ক্রমেই এগিয়ে গিয়েছে নিজের লক্ষ্যের জালের দিকে। আর আজ জয়পুর আরবিবি হাইস্কুলের কন্যাশ্রী ক্লাব ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন ওই কিশোরী। তার পায়ের জাদু ও নেতৃত্ব দানের ক্ষমতাতেই আজ ওই স্কু্লের টিম জেলায় কন্যাশ্রী ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন দলের শিরোপা পাইয়ে দিয়েছে।
খেলাধুলোকে ঘিরে কিশোরী শীলার এই সাফল্যের কাহিনির মতোই ঝাড়খণ্ড ও অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেও দুই কিশোর-কিশোরী তাঁদের উত্তরণের কথা শোনাবে কলম্বোয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। ক্যানসারের মতো মারণরোগের সঙ্গে লড়াইয়ে জয়ী ক্রিকেটার যুবরাজ সিংয়ের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান ও শ্রীলঙ্কার অনুর্ধ্ব-১৯ এর ক্রিকেটাররাও ওই সম্মেলনে হাজির থাকবেন। ইউনিসেফের পক্ষে এ রাজ্যের চাইল্ড প্রোটেকশন বিশেষজ্ঞ (অ্যাডোলেসেন্স এনগেজমেন্ট) স্বপ্নদীপা বিশ্বাস বলেন, “খেলাধুলোর মধ্যে দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নে ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে শীলা আমাদের কাছে রোল মডেল। সেই কারণেই কলম্বোর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” এমন একটি আন্তর্জাতিক আঙিনায় নিজের লড়াইয়ের কথা তুলে ধরতে পারবে বলে ভীষণই উচচ্ছসিত শীলা। তার কথায়, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাশ্রী প্রকল্প আমাদের মুখে ভাষা দিয়েছে, ক্ষমতা দিয়েছে। এমনকী, স্বনির্ভর হওয়ারও সাহস জুগিয়েছে। আমি সে কথাইই বলতে চাই।” পুরুলিয়ার জেলাশাসক অলোকেশ প্রসাদ রায় এ খবর শোনার পর বলেন, “শীলা আমাদের গর্বিত করেছে। কন্যাশ্রীর জন্যই আজ প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা এভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় আসছে।”
ছবি: অমিত সিং দেও
[সততাই মূলধন, ৪৩ হাজার টাকা পেয়েও ফেরালেন এই চা-বিক্রেতা]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.