মোহনবাগান অন্ত প্রাণ ত্রিদীপ সীট।
দেবাঞ্জন নন্দী: শরৎকালের অপেক্ষায় দিন গোনে বাঙালি। বড়পুজোর জন্য বছরভর প্রতীক্ষার প্রহর গোনা শুরু হয়ে যায়। নতুন জামা কাপড়ের ঘ্রাণ পাগল করে বঙ্গ-সমাজকে। শুরু হয় কেনাকাটা। শরতের নীল আকাশ আর পেঁজা তুলোর মতো মেঘ দেখে আমবাঙালির বুকে মন্দ্রিত হয় সেই কণ্ঠস্বর, ”আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর…প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা।”
হাওড়া শিবপুরের ডঃ ত্রিদীপ সীট তাকিয়ে থাকেন ডার্বির দিকে। বাঙালির দুর্গাপুজোর বাইরেও যে রয়েছে আরও একটা বড় পুজো, রয়েছে আরও একটা উৎসব। তা হল মোহন-ইস্টের বড় ম্যাচ। হালআমলের ডার্বি।
বাঙালির বড় আবেগের, বড় প্রিয় মোহন-ইস্ট দ্বৈরথের সূচি ঘোষণা হলেই ত্রিদীপের বুকেও হয়তো ডার্বি-ধ্বনি সুর-ছন্দ তোলে। অনেক আশা-আকাঙ্খা ভিড় জমায় হৃদয়ে। নতুন জামা কাপড়েই ডার্বির স্বাদ নিতে মুখিয়ে থাকেন তিনি। ত্রিদীপের কাছে ডার্বি মানেই দুর্গাপুজোর আবহ। বড় পুজোর মহল। বড় উৎসব।
দেখতে দেখতে শনিবার আরও একটা ডার্বি ম্যাচ। আরও একটা পুজো। অনন্ত এক অপেক্ষার অবসানও বটে। মহনদীর তীরে শেষ দেখা। তার পরে আবার যুবভারতীতে দুই প্রধান মুখোমুখি। শহরের সব রাস্তা এসে শনিসন্ধেয় মিশে যাবে প্রাণের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। সেখানে বসবে এক মিলনমেলা। সমর্থকদের ভিড়, উদযাপন, তাঁদের স্লোগান-আবেগ মিলেমিশে এক অপার্থিব জগৎ তৈরি করবে।
দুর্গাপুজোর নবমী এলেই বিষাদের সুরে মন বলে ওঠে, যেও না নবমী নিশি…। তেমনই ডার্বি-পুজো এলেই যে তা নিমেষে চলে যাবে। মুহূর্তের মধ্যে নিঃশেষিত হবে আবেগ-উৎকণ্ঠার টানটান নব্বই মিনিট। ত্রিদিপবাবুর মতো একনিষ্ঠ সমর্থক যাঁরা, তাঁদের কাছে ক্লাব মাতৃসমা। এমন সমর্থকদের ভালোবাসা-প্যাশনেই এখনও কলকাতা ময়দানের দুই মন্দির মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলে প্রাণের জোয়ার বয়ে চলেছে। চায়ের পেয়ালায় ওঠে তর্ক। এগিয়ে চলে কলকাতার ফুটবল, বাঙালির ফুটবল।
ত্রিদীপবাবু মলিকিউলার বায়োলজির অধ্যাপক। শিক্ষকতার বাইরে রয়েছে তাঁর আরও একটা জগৎ। সেই জগতের রং সবুজ-মেরুন। মোহনবাগান নাম তাঁর রক্তের গতি বাড়িয়ে তোলে। তাঁর বুকে কাঁপন তোলে। শ্বাসপ্রশ্বাসে তাঁর মোহনবাগান। সবুজ-মেরুনের আকর্ষণে তিনি ভুলে যান সব কিছু। ডার্বি ম্যাচ তাঁর কাছে ডার্বি পুজো ছাড়া অন্য কিছু নয়। বড় ম্যাচে নতুন জামা পড়েন ত্রিদীপবাবু। তাঁকে দেখে কে বলবে, বাঙালি আজ প্যাশন হারিয়েছে…!
সবুজ-মেরুনের প্রতি ভালোবাসা-প্যাশন-আবেগ তিনি বয়ে নিয়ে চলেছেন সেই কবে থেকে। গত কুড়ি বছর ধরে প্রতিটি বড় ম্যাচে নতুন জামা পরা তাঁর চাই-ই চাই। সবুজ-মেরুন গেঞ্জি হোক কিংবা নতুন পাঞ্জাবি বা অন্য কোনও পরিধেয়, মোহন-ইস্টের টেনশন ঝরানো ম্যাচে তাঁকে স্টেডিয়ামে দেখা যাবে নতুন পোশাকেই। এ তাঁর অভ্যাস। মোহনবাগানের জয় বা পরাজয়ে, ভালো বা খারাপ সময়ে এমন অভ্যাসের কোনও পরিবর্তন হয় না।
ত্রিদীপের কথায়, ”মোহনবাগানের ভীষণ খারাপ সময়েও (২০০৯-২০১৪) এই অভ্যাসের কোনও পরিবর্তন হয়নি। অনেক ম্যাচ জিতেছি কিংবা হেরেছি কিন্তু নতুন জামা পরে বড় ম্যাচ দেখা মাস্ট।” এ নিয়মের অন্যথা হয় না। সারাদিনের ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যে ‘মোহনবাগান’ নাম জপেন তিনি। এ যে তাঁর জপ-মালা।
সম্প্রতি তিনি কাজ করেছেন মোহনবাগানের হকি দল নিয়ে। তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে মোহনবাগানের হকি দলের অজানা অনেক তথ্য। ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে উঠে এসেছে হকি সংক্রান্ত নতুন নতুন তথ্য। ‘সৃতিসত্তায় মোহনবাগান’ বইটিতে আছে হকির নানান বিবরণ। যা পড়ে সমৃদ্ধ হওয়া যায়।
অক্ষয় হোক ত্রিদীপের এই নিখাদ মোহনবাগান-প্রেম, ভালোবাসা। এমন ত্রিদীপরা যেন হারিয়ে না যান বাংলার ফুটবল থেকে। এগিয়ে চলুক ফুটবল, দীপ জ্বালিয়ে যান ত্রিদীপরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.