সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল। ব্রাজিলের সামনে ইটালি। ফাইনাল চলাকলীন ব্রাজিলের কোচ কার্লোস আলবার্তো পাহিরা তাঁকে বললেন, ”জর্জিনহোর চোট। ওয়ার্ম আপ করতে শুরু কর।” কোচের এমন নির্দেশ প্রত্যাশিত ছিল না সেই ফুটবলারের কাছে। পাহিরার কথা শুনে বিস্মিত ফুটবলারটি কোচকেই পালটা জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ”কে আমি?” তার পরের ঘটনা ইতিহাস। ১৯৯৪ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের নাম ব্রাজিল। আর কোচ পাহিরা যাঁকে বলেছিলেন, দ্রুত ওয়ার্ম আপ করে তৈরি হয়ে নাও–তিনি কাফু (Cafu)। ১৯৯৪ সালের বিশ্বজয়ী দলের সদস্য। পরবর্তী কালে ব্রাজিলের ক্যাপ্টেন হয়ে ২০০২ বিশ্বকাপ হাতে তুলেছিলেন।
এহেন মহাতারকা এসেছিলেন কলকাতায়। ‘তাহাদের কথা’ নামের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বেঙ্গল পিয়ারলেস হাউজিং ডেভেলপমন্ট কোম্পানির সিইও কেতন সেনগুপ্ত (Ketan Sengupta)। তাঁর প্রশ্নেই বেরিয়ে এল কাফু সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য। ফুটবলমাঠে ঝড় তোলা তারকার জীবন যে কত ঘাত-প্রতিঘাত-সংঘাতে ঠাসা, কত লড়াইয়ের পর মেলে স্বীকৃতি, আবার কত ঘাম ঝরানোর পরই সাফল্যের শৃঙ্গে ওঠা যায়, তাই যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে কেতন সেনগুপ্তের সঙ্গে কাফুর আলাপচারিতায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শতদ্রু দত্ত, যিনি কাফুকে এশহরে এনেছিলেন। ছিলেন ভারতের প্রাক্তন ফুটবলার বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যও।
১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ব্রাজিলের (Brazil) সঙ্গে ইংল্যান্ডের (England) খেলা। ক্যালেন্ডারের পাতা বলছে ১৯৭০ সালের ৭ জুন। জর্জিনহোর গোলে সেই ম্যাচ জিতেছিল ব্রাজিল। তখন বিশ্বকাপের নাম ছিল জুলে রিমে কাপ। সেবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। ব্রাজিল-ইংল্যান্ড ম্যাচের দিনই জন্ম নিয়েছিল এক শিশু। পরবর্তীকালে সেই শিশুই বড় হয়ে দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন। এক বিদেশি সংবাদ মাধ্যম একবার কাফুকে প্রশ্ন করেছিল, ”তুমি কেন প্রফেশনাল ফুটবলার হলে?” উত্তরে ব্রাজিলের প্রাক্তন অধিনায়ক বলেছিলেন, ”আই ওয়াজ বর্ন ইন ১৯৭০।” ফুটবলার হওয়া ছাড়া কাফুর পক্ষে দ্বিতীয় কিছু হওয়া সম্ভবও ছিল না। যাঁর জন্মমুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ব্রাজিলের বিশ্বজয়ের কাহিনি, সেই ছেলে যে একদিন ভুবনবিখ্যাত ফুটবলারই হবে, এ তো বলাই বাহুল্য। অনুষ্ঠানের শুরুতে সেই সুর বেঁধে দিয়েছিলেন কেতন সেনগুপ্ত।
বেঙ্গল পিয়ারলেস হাউজিং ডেভেলপমন্ট কোম্পানির সিইও যখন ১৯৭০ সালের ৭ জুনের উল্লেখ করলেন, তখন কাফু স্মৃতিরোমন্থন করে বললেন, ”ওই ম্যাচটায় জর্জিনহো গোল করেছিলেন।” ফুটবল বিশ্ব তাঁকে কাফু নামে চেনে। কিন্তু তাঁর আসল নাম যে মার্কোস ইভানজেলিস্তা দি মোরাএস। তাঁর আসল নাম চলে গেল পিছনের সারিতে। তার পরিবর্তে কাফু নামেই তিনি জনপ্রিয়, কাফু নামেই তাঁর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি। কীভাবে তিনি হয়ে গেলেন কাফু? উত্তরে তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা বিখ্যাত ব্রাজিলীয় কেতন সেনগুপ্তকে বললেন, ”ফ্লুমিনেন্সেতে একজন ফুটবলার খেলত। তাঁর নাম ছিল কাফুরিঙ্গা। সেও আমার মতোই রাইট ব্যাক পজিশনে খেলত। আমিও রাইট ব্যাক। আমার নাম কালক্রমে হয়ে গেল কাফু।”
কথায় বলে, ব্যর্থতাই সাফল্যের সোপান তৈরি করে। কাফুর ক্ষেত্রে কথাগুলো খুব প্রযোজ্য। সাও পাওলোর মূল দলের জার্সি পরে খেলার আগে ন’ বার ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। কাফুর বই থেকে সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরেন কেতন সেনগুপ্ত। সেই প্রসঙ্গে আবেগপ্রবণ ব্রাজিলীয় ক্যাপ্টেন বলছিলেন, ”প্রতিবার ব্যর্থ হওয়ার পরে বাবা আমাকে বলতেন, ঈশ্বর তোমার চলার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন। তোমাকেই সেই বাধা অতিক্রম করতে হবে।” সামনে আসা যাবতীয় বাধা পেরিয়ে কাফু এগিয়ে গিয়েছিলেন।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম কাফুর। ফুটবল কিনে খেলার পয়সা নেই। সহায় সম্বলহীন অবস্থা পরিবারের। কাফু স্মৃতিরোমন্থন করে বলছেন, ”মোজার ভিতরে কাগজ ঢুকিয়ে বল তৈরি করে খেলতাম। আমার বড় দাদা আমার থেকেও প্রতিভাবান ফুটবলার ছিলেন। আমরা ছয় ভাই। প্রত্যেকে ফুটবল খেলত। কিন্তু প্রত্যেককে ক্লাবে ভর্তি করে টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না আমার পরিবারের। তাই দাদা স্বার্থত্যাগ করেন। ফুটবল ছেড়ে দেন। আমাকে সুযোগ করে দেন ফুটবল খেলার। এর জন্য দাদার মনে কোনও দুঃখ ছিল না। ছিল না অনুশোচনা।বরং দাদা খুবই খুশি ছিলেন যে আমি ফুটবল খেলতে পারছি। সেই সময়গুলো বড্ড কঠিন ছিল। আমি পেশাদার ফুটবলার হওয়ার পরে দাদা খুব খুশি হয়েছিলেন।”
দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলে দুই পাওয়ার হাউজ দেশ ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। ফুটবল খেলাকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন এই দুই দেশের ফুটবলাররা। ফুটবল সম্রাট পেলে, ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা, রোনাল্ডো, রিভাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, এই সময়ের মহানায়ক লিওনেল মেসি, নেইমার–নাম বলতে শুরু করলে তা দীর্ঘায়িতও হবে। এত প্রতিভার বিচ্ছুরণ কীভাবে সম্ভব এই দুই দেশের ফুটবলে? কাফুকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন শতদ্রু দত্ত। বিখ্যাত ২ নম্বর জার্সিধারী আবেগ গলায় এনে বলছিলেন, ”প্রতিভা তো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার রক্তে। পেলে, মারাদোনা, রোনাল্ডো, রিভাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, মেসি, নেইমার–এঁরা সবাই ক্ষণজন্মা প্রতিভা।”
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে কাফু একজন ফুটবলার হিসেবে খেলেছিলেন। ২০০২ সালে তাঁর হাতেই উঠেছিল ব্রাজিল দলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। ফাইনালে জার্মানিকে মাটি ধরিয়ে বিশ্বকাপ তুলেছিলেন কাফু। ব্রাজিলের দল ছিল সোনায় মোড়ানো। দলের একেক জন রত্ন। কাফুর পক্ষে কতটা কঠিন ছিল সেই তারকাসমৃদ্ধ দলকে নেতৃত্ব দেওয়া? তিনি বলছিলেন, ‘২০০২ সালে ব্রাজিলে চারজন দুর্দান্ত ফুটবলার ছিল-কাকা, রিভাল্ডো, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো। এরকম প্লেয়ার পেলে যে কোনও ক্যাপ্টেনের কাজ সহজ হয়ে যায়। সময়ের থেকে ওরা অনেক এগিয়ে ছিল। দলের জন্য খেলত, নিজেদের জন্য খেলত না। একটা দল হিসেবে খেলেছিলাম বলেই সেবার আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছিলাম।”
ব্রাজিল থেকে আসার আগেই ভারতের ফুটবল সম্পর্কে শুনেছিলেন। ভারতে ক্রিকেট এখন জনপ্রিয় খেলা। কাফু বলছেন, তিনিও অল্পস্বল্প ক্রিকেট খেলেছেন। ভারতীয় ফুটবল সম্পর্কে আরও বেশি করে শুনেছেন এলানো, রবার্তো কার্লোস, দেল পিয়েরোর মতো ভুবনবিখ্যাত সব ফুটবলার এদেশের মাঠ কাঁপিয়ে যাওয়ায়। বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেন ভারতের পক্ষে কি বিশ্বকাপ খেলা সম্ভব? উত্তরে কাফু বলছেন, ”দলের সংখ্যা বেশি হতে হবে আইএসএলে। ম্যাচের সংখ্যাও বেশি হওয়া দরকার। আর গোটা মরশুম জুড়ে টুর্নামেন্ট হতে হবে। ছয়-সাত মাস খেলা হল আর বাকি সময়টা ছুটি, তা করলে চলবে না।” তরুণ খেলোয়াড়দের তুলে আনতে হবে, ফুটবলে পেশাদারিত্বের প্রয়োজন, লিগ আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়ার দরকার, তবেই সিঁড়ি বেয়ে বিশ্বকাপে যাওয়া সম্ভব। কলকাতায় এসে এটাই টোটকা কাফুর।
নতুন, অপিরিচিত এক দেশের ফুটবলের উন্নতির জন্য ব্লু প্রিন্ট ছকে দিয়ে গেলেন বহু যুদ্ধের সৈনিক। সেই সঙ্গে নিজের জীবনের অজানা অধ্যায়ও তুলে ধরলেন এখানকার ফুটবলপ্রেমীদের কাছে। কলকাতা ছেড়েছেন কাফু। কিন্তু শহরের শ্বাসপ্রশ্বাসে যে এখনও তিনি রয়ে গিয়েছেন। আকাশ-বাতাসে বারংবার অনুরণিত হচ্ছে, একদা ব্যর্থ এক ছেলের বিশ্বজয়ের কাহিনি।
দেখুন ভিডিও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.