কৃশানু মজুমদার: সবুজ-মেরুন জার্সি পরে বল পায়ে তিনি ছবি আঁকতেন। উইং ধরে দৌড়তে দৌড়তে বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের সম্মোহীত করে ভিতরে ঢুকে পড়তেন। তার পরেই রামধনুর মতো বাঁকানো শটে বিপক্ষের জালে জড়িয়ে দিতেন বল। গ্যালারিতে উঠত শোর ‘গো-ও-ও-ল।’ হাত দুটো পাখির মতো শূন্যে ভাসিয়ে গোল উদযাপন করতেন। তিনি সোনি নর্ডি (Sony Norde)। মোহনবাগান (Mohun Bagan) সমর্থকদের একসময়ের প্রাণভোমরা।
বছর তিনেক হল বাগান ছেড়ে তিনি চলে গিয়েছেন। সোনিকে নিয়ে এখনও স্বপ্ন দেখেন সবুজ-মেরুন সমর্থকরা। অনেক সমর্থকের কাছে এখনও তিনি ঈশ্বর। তাঁদের শ্বাস প্রশ্বাসে রয়ে গিয়েছেন হাইতিয়ান ম্যাজিশিয়ান।
সোনির ঠিকানা মালয়েশিয়া। মেলাকা ইউনাইটেডের জার্সিতে তিনি গোল করছেন, গোল করাচ্ছেন, পায়ের কাজ দেখাচ্ছেন। মেলাকা ইউনাইটেডের সমর্থকদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছেন সোনি নর্ডি।
চলতি মাসের ৭ তারিখ এএফসি কাপের ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালে (AFC Cup Inter Zonal Semi Final) মোহনবাগানের সামনে কুয়ালালামপুর সিটি এফসি। আগামী ১৫ তারিখ মালয়েশিয়া সুপার লিগে সোনির মেলাকা ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে নামবে কুয়ালালামপুর সিটি এফসি। শোনা যাচ্ছে, আগামী মরশুমে জার্সির রং বদলাবে সোনির। মেলাকা ছেড়ে তিনি যোগ দেবেন কুয়ালালামপুর সিটি এফসি-তে। যদিও সেই জল্পনাতে জল ঢালছেন স্বয়ং হাইতিয়ান ম্যাজিশিয়ান। তিনি বরং ডুব দিচ্ছেন এএফসি কাপের ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালে।মালয়েশিয়া থেকে ফেরান্দোর দলকে সতর্ক করে দিয়ে সোনি বলছেন, ”আমি বিশ্বাস করি মোহনবাগান ইতিহাস তৈরি করতে পারবে। তবে মোহনবাগানের জন্য কাজটা কিন্তু মোটেও সহজ নয়।”
কিন্তু কেন এমন কথা বলছেন সোনি? ফেরান্দোর দলেও তো রয়েছেন একাধিক মণিমুক্তো। আক্রমণের ঢেউ তুলে প্রতিপক্ষের রক্ষণ বেসামাল করে দেন লিস্টন কোলাসো, জনি কাউকো, হুগো বুমোসরা। সোনি বলছেন, ”কলকাতা ছেড়ে চলে আসার পরে মোহনবাগানের খেলা আর দেখিনি। এই ম্যাচটা মোহনবাগানের জন্য খুবই কঠিন হতে চলেছে। মালয়েশিয়ান সুপার লিগের অন্যতম শক্তিশালী দল কুয়ালালামপুর সিটি।”
মোহনবাগানের আসন্ন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একাধিকবার খেলেছেন সোনি। গত ৯ এপ্রিল মেলাকা আর কুয়ালালামপুর সিটি-র সাক্ষাত হয়েছিল। হার মেনেছিলেন সোনিরা। মালয়েশিয়া সুপার লিগে কুয়ালালামপুর এখন পাঁচে। সেই জায়গায় মেলাকা অনেকটাই পিছিয়ে। ৯ নম্বরে। সোনি বলছেন, ” ছ’ বারের বেশি মুখোমুখি হয়েছি কুয়ালালামপুরের বিরুদ্ধে।ওদের বিদেশি প্লেয়াররা বেশ উঁচুমানের। স্থানীয় ফুটবলাররাও বেশ ভাল।”
এর আগে এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বে গোকুলাম কেরলের কাছে হেরে গিয়েছিল মোহনবাগান। ওই হার বদলে দেয় ফেরান্দোর দলকে। বাংলাদেশের দল বসুন্ধরা ও মাজিয়াকে উড়িয়ে দিয়ে ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালের ছাড়পত্র জোগাড় করে মোহনবাগান। সোনি বলছেন, ”আক্রমণে কুয়ালালামপুর দারুণ শক্তিশালী। ওদের আসল শক্তির জায়গা সেট পিস।” একসময়ে স্বয়ং সোনি সেট পিস থেকে আপেল চাষ করে গিয়েছেন। শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত ডার্বি ম্যাচে ফ্রি কিক থেকে ইস্টবেঙ্গলের জাল কাঁপিয়েছিলেন। তার পরে স্টেনগান চালানোর ভঙ্গিমায় গোল উদযাপন করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। সেই উদযাপন এখন আইকনিক হয়ে গিয়েছে।
মহাযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে ফেরান্দোর দল। ডুরান্ড কাপে গোলের সুযোগ নষ্ট করেছে মোহনবাগান। সেই রোগের পাশাপাশি ডিফেন্সও নিশ্ছিদ্র দেখায়নি বাগানের। রক্ষণের এই দুর্বলতা চিন্তা বাড়িয়েছে স্পেনীয় কোচের। সেই কারণেই রক্ষণ সংগঠিত করে আক্রমণে জোর দিতে চাইছেন ফেরান্দো। দূর থেকে স্পেনীয় কোচের উদ্দেশে সোনির বার্তা, ”ওদের কলম্বিয়ান ফুটবলার রোমেল মোরালেস, ব্রাজিলীয় পাওলো জোসুকে নজরে রাখতে হবে।দু’জনকে সামলাতে না পারলে কিন্তু সমস্যায় পড়তে হতে পারে মোহনবাগানকে।”
লড়াইটা দুই ধুরন্ধর কোচেরও। স্পেনীয় বনাম ক্রোয়েশিয়ান কোচের মগজাস্ত্রের লড়াইও উপভোগ্য হতে পারে ভরা যুবভারতীতে। কুয়ালালামপুরের কোচ বোজান হোডাক। ক্রোয়েশিয়ান কোচ বদলে দিয়েছেন কুয়ালালামপুর সিটিকে। ৩২ বছর পরে ২০২১ সালে বোজানের কোচিংয়ে মালয়েশিয়া কাপ জিতেছে কুয়ালালামপুর। ২২ বছর পরে কাপ ফাইনালে (১৯৯৯ মালয়েশিয়া এফএ কাপের পরে) দলকে তুলেছেন ক্রোয়েশিয়ান কোচ। বোজানকে ঢালাও সার্টিফিকেট দিয়ে হাইতিয়ান তারকা বলছেন, ”আমার দেখা অন্যতম সেরা কোচ বোজান হোডাক।তাঁর হাতে পড়ে এশিয়ার অন্যতম সেরা দল হয়ে উঠেছে কুয়ালালামপুর। বোজানের কোচিং পদ্ধতি আমাকে মুগ্ধ করেছে।”
একসময়ে সবুজ-মেরুন গ্যালারিতে ধ্বনি উঠত, ”তুমি বললে ডার্বি, আমি শুনলাম সোনি নর্ডি।” বাংলাদেশের ক্লাব শেখ জামাল থেকে মোহনবাগানে আসার পরে সোনি-মায়ায় আচ্ছন্ন থেকেছে মোহন-সমর্থকরা।বড় ম্যাচের একসময়ের ভাগ্যনিয়ন্তা গত ২৮ আগস্টের ডুরান্ড-ডার্বি দেখেননি। যে সময়ে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ইস্ট-মোহনের রক্তের গতি বাড়িয়ে দেওয়া লড়াই চলছিল, তখন তিনি অনুশীলনে ব্যস্ত ছিলেন।
আসন্ন বারুদে ঠাসা ম্যাচের আগে মোহনবাগানের জন্য একবুক শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন সোনি। বলছেন, ”মোহনবাগান সমর্থকদের জন্য শুভেচ্ছা রইল। এখনও তোমাদের আমি ভালবাসি।” সমর্থকদের ভালবাসায় একসময়ে ভিজেছেন সোনি। বাগান ছাড়ার আগে তাঁর চোখে নেমেছিল জলের ধারা। এই দেশ ছেড়ে চলে গেলেও মোহনবাগানকে কীভাবে ভুলবেন তিনি! সোনি ও মোহনবাগানের সম্পর্ক যে বহু পুরনো। কেউ ভোলেননি কাউকে। বাগানে সোনির কাহিনি যেন মান্না দে-র সেই গান, ‘হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.