২০ মার্চ, ২০০৩। এই দিনেই চিরনিদ্রায় গিয়েছিলেন বাংলার বিখ্যাত ফুটবলার কৃশাণু দে। আজ ১৭ বছর পর একই দিনে চলে গেলেন তাঁর গুরু পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। এ কি নিছকই সমাপতন? স্মৃতিতে ডুব দিলেন কৃশাণুপুত্র সোহম দে।
২০ মার্চ তারিখটাই বোধহয় ভারতীয় ফুটবলের জন্য অভিশপ্ত। সতেরো বছর আগে ঠিক এই তারিখেই ভারতীয় ফুটবল হারিয়েছিল তার মারাদোনাকে। আটের দশকের বাঙালির চিরআবেগের সেই নামের কথাই বলছি- কৃশাণু দে। আমার বাবি। আর শিষ্যের প্রয়াণ দিবসেই গুরু পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ও দীর্ঘ লড়াইয়ের পর প্রয়াত হলেন। ভারতীয় ফুটবলের এক আশ্চর্য সমাপতনই বটে।
ছোটবেলায় ফুটবল নিয়ে অত বেশি আবেগ ছিল না। বাড়িতেও বাবির সঙ্গে ছাদে ক্রিকেটই খেলতাম। তাতেও অনেক সময় বাবির সঙ্গে ফুটবল নিয়ে আড্ডা দিয়েছি। যতবারই জিজ্ঞেস করেছি কোন কোচ তোমার কাছে সেরা। জবাবটা আসত, ‘‘প্রদীপদাই আমার কাছে সেরা কোচ।’’
বাবির কাছে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় মানে নিছকই একজন কোচ নয়। বরং পিতার মতোই শ্রদ্ধা করতেন। ভারতীয় ফুটবল ভক্তদের জন্য তিনি পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় হলেও আমি ডাকতাম পিকে জেঠু বলে। তখনকার দিনে স্থানীয় সমস্ত ক্লাবে প্রচুর চিফ গেস্টের প্রোগ্রাম হত। অতিথি হিসাবে ডাকা হত প্রাক্তন ফুটবলারদের। অধিকাংশ প্রোগ্রামেই বাবি ও পিকে জেঠু একসঙ্গে যেত। দু’জনের দেখা হওয়া মানেই শুরু হত ফুটবল আড্ডা। বাবা যখনই ঘরোয়া কোনও অনুষ্ঠানে প্রদীপ জেঠুকে আমন্ত্রণ করতেন সব সময় উনি উপস্থিত থাকতেন। আমার অন্নপ্রাশনের অ্যালবাম ঘাঁটতে ঘাঁটতে কতবার সেই ছবিটা দেখেছি যেখানে পিকে জেঠুর কোলে আমি।
ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আসার পরেও বহুবার পিকে জেঠুর সল্টলেকের বাড়িতে গিয়েছি। মনে আছে তখন আমি এক ম্যাগাজিনের হয়ে কাজ করছি। ম্যাগাজিনের এক বছর পূর্তিতে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যে করেই হোক পিকে জেঠুকে সেই অ্যানিভার্সারি স্পেশ্যাল সাংবাদিক সম্মেলনে আনতেই হবে। সেই সময় অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না পিকে জেঠুর সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই পিকে জেঠুকে ফোন করার পর প্রথমে উনি চিনতে পারেননি। তারপর বলেছিলাম, ‘‘চিনতে পারলে না আমায়। তোমার প্রিয় রন্টুর ছেলে।’’ আর সেটা শোনার পরেই সঙ্গে সঙ্গে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
বলেছিলেন, ‘‘আমার বাড়ি চলে আয়। তারপর কথা হবে।’’ পরের দিন সকালে উপস্থিত হলাম পিকে জেঠুর বাড়ি। আমাকে দেখেই বলল, ‘‘রন্টু একবারই আমার কথা অমান্য করেছিল। সেটা ছিল ২০ মার্চ। তোর বাবা আমার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল। যা বলেছি সেটা শুনেছে। খুব শান্ত স্বভাবের ছিল। খুব বেশি বকা দিতে হয়নি।’’ আমার অনুরোধ আর ফেলতে না পেরে পিকে জেঠু উপস্থিত হয়েছিলেন সেই সাংবাদিক সম্মেলনে। দীর্ঘক্ষণ সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডাও দিয়েছিলেন। সেই দু’দিন পিকে জেঠুর সঙ্গে কাটানোর পর বুঝেছিলাম ছাত্রের চলে যাওয়ার দুঃখ গুরু হয়তো ভুলতে পারেননি।
যাই হোক আজ সে সব গল্প শুধুই সোনালি ইতিহাস। দুপুরে যখন শুনলাম প্রদীপ জেঠু আর নেই খুবই খারাপ লাগল। শুধু মনে পড়ছিল মায়ের মুখে শোনা সেই গল্পটার কথা। মহামেডানের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ। ইস্টবেঙ্গল কোচ তখন পিকে জেঠু। ইস্টবেঙ্গলের প্রথম দলে না রাখায় অভিমান করে বসেছিল বাবি। তারপর মাঠে নামানোর পরে বাবির বাড়ানো দুটো পাসেই ম্যাচটা ২-১ জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল।
কাকতালীয়ভাবে একই তারিখে বাবি আর পিকে জেঠুর মৃত্যুদিনটা পড়ে যাওয়ায় ঘুরেফিরে একটা কথাই মনে হচ্ছে। আজ নিশ্চয়ই ফুটবল-স্বর্গে গুরু- শিষ্যের দেখা হবে। সেই ইস্টবেঙ্গল ম্যাচটা নিয়ে নিশ্চয়ই কথাও হবে। সেটা হলে বাবির এতদিনকার জমে থাকা অভিমানটাও কি হালকা করে দেবে না পিকে জেঠু? কে না জানে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু একজন বড় ফুটবলারের নাম নয়, শুধু একজন বড় কোচের নাম নয়, একজন চূড়ান্ত দক্ষ ম্যান ম্যানেজারের নামও বটে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.