বিশ্বদীপ দে: পেলে (Pele) নেই। নতুন বছরের ‘নতুন সূর্য’ আর দেখা হল না ফুটবল সম্রাটের। মহাতারকার প্রয়াণের খবর পেয়েই তারকা থেকে সাধারণ ফুটবল ভক্ত, সকলেই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন মহাতারকাকে। শুরু হয়েছে স্মৃতিচারণ। তিনটি বিশ্বকাপ জয় থেকে ‘কালো হিরে’র সমস্ত নজির উঠে আসছে আলোচনায়। আর সেই সঙ্গেই অবধারিত ভাবে উঠে আসছে আরও একটা নাম। দিয়েগো মারাদোনা (Diego Maradona)।
ফুটবলের শীর্ষস্থানটি কার? ব্রাজিলীয় (Brazil) না আর্জেন্টেনীয়র (Argentina)? এই বিতর্ক আজও অব্যাহত। মেসি-রোনাল্ডো বিতর্ক এসেও যে বিতর্ককে ধামাচাপা দিতে পারেনি। সেই সঙ্গে রয়ে গিয়েছে আরও একটা প্রশ্ন। দুই মহাতারকার সম্পর্ক ঠিক কেমন ছিল? সত্যিই কি দু’জন অপছন্দ করতেন পরস্পরকে।
কবে দেখা হয়েছিল দু’জনের? ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে প্রথম বার দেখা হয়েছিল তাঁদের। সেই সময় মারাদোনার বয়স ১৯ বছর। বয়সে দুই দশকের বড় ফুটবল কিংবদন্তি পেলে সেদিন মহাসম্ভাবনাময় কিশোরটিকে উপহার দিয়েছিলেন ঘড়ি। কাঁধে হাত দিয়ে দিয়েছিলেন এক দামি উপদেশ, ”কেউ যদি তোমাকে সেরা বলে পাত্তা দিও না। সব সময় নিজেকে বলে যেও, তুমি সেরা নও।” উদীয়মানের মধ্যে সাফল্যের খিদে জাগিয়ে রাখতে অব্যর্থ টিপস। সেদিন কারও কল্পনাতেও ছিল না একদিন এই দুই অসমবয়সি তারকার মধ্যে তুলনাকে ঘিরে দ্বন্দ্বে মেতে উঠবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। ভুল! যেন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে ফুটবল বিশ্ব।
২০০০ সালে প্রকাশিত হয় মারাদোনার আত্মজীবনী। তাতে সরাসরি আঙুল তোলা হয়েছিল পেলের দিকে! দিয়েগোর অভিযোগ ছিল, সতীর্থ গ্যারিঞ্চা যখন অ্যালকোহল আসক্তির কবলে পড়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছিলেন, উদাসীন ছিলেন পেলে। স্বাভাবিক ভাবেই এমন কথায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন পেলে। ‘বদলা’ নিতে পেলের জীবনীতে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেলসো গ্রেলেটও মারাদোনাকে কটাক্ষ করে বসেন।
দুই মহাতারকার মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে এর ঠিক পরে। ওই বছরই। ‘শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়’ বেছে নিতে অনলাইন ভোট নেয় ফিফা। বিপুল ব্যবধানে পেলেকে হারিয়ে সেই খেতাব জিতে নেন মারাদোনা। কিন্তু পেলের অনুরাগীরা দাবি করলেন, যেহেতু ভোট দিয়েছে আমজনতা, তাই বহু আগে অবসর নেওয়া পেলেকে গুরুত্ব না দিয়ে সদ্য অবসর নেওয়া মারাদোনার পক্ষেই তাঁদের ভোট যাবে এটা স্বাভাবিক। এরপর ফিফা আবার একটি ভোট নেয়। এবার সাংবাদিক, কোচ ও ফুটবলের সঙ্গে যুক্তদেরই কেবল ভোট দিতে বলা হল। সেই ভোটে আবার জিতে গেলেন পেলে। ইতিহাসের অমোঘ ইশারায় আসলে অমীমাংসিতই যেন রয়ে গেল এই তুলনা।
পরবর্তী কয়েক বছর ধরেও সেই তিক্ততা অব্যাহত ছিল। ২০১৭ সালে পেলে জানিয়ে দেন, তাঁর সঙ্গে মারাদোনার তুলনা অনুচিত। তিনি বলেন, ”আমরা কখনওই বলতে পারি না মারাদোনা একজন দারুণ হেডার। ও হেড থেকে খুব বেশি গোল করেনি।” সেই সঙ্গে মারাদোনার কেবল বাঁ পায়ে ফুটবল খেলা নিয়েও তাঁর কটাক্ষ,”লোকে যখন তুলনা করে আমি রসিকতা করি এটা নিয়ে। ও অবশ্যই মহান খেলোয়াড়। কিন্তু আপনাদের পেলে ও মারাদোনার তুলনা করা উচিত নয়।” তবে সেই সঙ্গে ফুটবল সম্রাট দাবি করেছিলেন, এখন তিনি ও দিয়েগো ‘ভাল বন্ধু’।
দু’জন যখনই মুখোমুখি হতেন, রসিকতা করতেন। একবার পেলে বলেছিলেনন, ”মারাদোনা, আমার সঙ্গে তুলনীয় হতে গেলে তোমাকে আরও ১ হাজার গোল করতে হবে।” উত্তরে মারাদোনা বলেছিলেন, ”সেটা আমি করতে পারব না। তবে তাতে কিছু যায় আসেও না।” কী আশ্চর্য সমীকরণ দুই মহাতারকার!
তবে সময় ধীরে ধীরে ক্ষতকে ঢেকে দেয়। আর মৃত্যু তো সমস্ত ক্ষততেই চিরপ্রলেপ দেয়। ২০২০ সালে দিয়েগোর মৃত্যুর পরে পেলে যখন বলেছিলেন, ”আমি খুব ভাল এক বন্ধুকে হারালাম, বিশ্ব হারাল এক কিংবদন্তিকে” তখন সেই উচ্চারণ বুঝিয়ে দিয়েছিল তাঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধার জায়গাটাও। পেলে বলেছিলেন, ”আমার আশা, একদিন আকাশে ফুটবল খেলব আমরা।” পেলের প্রয়াণ সেই কথাগুলিকেই যেন নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সমস্ত দ্বন্দ্বের শেষে মারাদোনা ও পেলে সত্য়িই যেন আসলে অতুলনীয়। আকাশে জ্বলজ্বলে দুই নক্ষত্রের মধ্যে কি কখনও তুলনা করা যায়? নিজস্ব আলোয় তাঁরা যে যার মতোই ঝলমলে। এবং চিরকালীন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.