Advertisement
Advertisement

Breaking News

ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে বসে একা একা কেঁদেছিলেন সুভাষ ভৌমিক! স্মরণসভায় উঠে এল অজানা কাহিনি

রাজ্য সরকারের ক্রীড়াগুরু পুরস্কার আর লাল-হলুদের জীবনকৃতি ছাড়া আর কিছু পাননি সুভাষ।

Once Subhash Bhowmick cried alone in East Bengal tent | Sangbad Pratidin
Published by: Krishanu Mazumder
  • Posted:February 2, 2022 10:36 am
  • Updated:February 2, 2022 11:33 am  

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: মাত্র বাহান্ন দিন আগে জীবদ্দশায় যখন শেষ বার ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে এসেছিলেন সুভাষ ভৌমিক(Subhash Bhowmick ), ক্লাব লনের একপাশে চেয়ারে বসে কেঁদেছিলেন একা একা। দুঃখের নয়। প্রাপ্তির কান্না, স্বীকৃতির কান্না। আসলে ইস্টবেঙ্গলের (East Bengal) নতুন মিউজিয়ামে ঢোকার মুখে বসানো হয়েছে সুভাষের মূর্তি। প্রখ্যাত পঞ্চপাণ্ডবেরও আগে। সুভাষ দেখে এতটাই সে দিন আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন যে, বাড়ি ফিরে ছেলে অর্জুনকে বলে দেন, এরপর মৃত্যু হলেও কোনও আক্ষেপ থাকবে না। বাহান্ন দিন পর মঙ্গলবারের ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে সুভাষ অশরীরী ভাবে উপস্থিত থাকলেন কি না, জানা নেই। কিন্তু তিনি সব দেখে থাকলে, দেবলোকে বসে নির্ঘাৎ ফের কেঁদেছেন। ঈশ্বরের কাছে পুনর্জন্ম প্রার্থনাও করেছেন নিশ্চয়ই। চেয়েছেন এ পোড়া দেশে আরও একবার জন্মাতে। ইস্টবেঙ্গল নামক এক আবেগকুণ্ডে আরও একবার আহুতি দিতে।

জীবদ্দশায় রাজ্য সরকারের ক্রীড়াগুরু পুরস্কার আর লাল-হলুদের জীবনকৃতি ছাড়া আর কিছু পাননি সুভাষ। দ্রোণাচার্য-পদ্মশ্রী-অর্জুন কিছুই না। অথচ সুভাষ এ দিন তাঁর ইস্টবেঙ্গল-স্মরণসভায় উপস্থিত থাকলে দেখতে পেতেন, স্বীকৃতির কত শত জয়মাল্য তাঁর জন্য অপেক্ষারত। কলকাতা পুরসভা নিউ আলিপুর বা কালিঘাটে সুভাষের নামে একটা উদ্যান করছে। তাঁকে মরণোত্তর দ্রোণাচার্য দিতে প্রাণপণ লড়াইয়ে নেমেছে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন আর ইস্টবেঙ্গল। দু’পক্ষই কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রকের কাছে দরবার করেছে। সুভাষ দেখতে পেতেন, ক্লাবেই স্পোর্টস ক্লিনিক করার যে কথা তিনি বারবার বলতেন লাল-হলুদ কর্তৃপক্ষকে, তা শেষ পর্যন্ত হচ্ছে। ক্লাবেই হচ্ছে, তাঁরই নামে। এবং সর্বোপরি, কোভিডের রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কী ভাবে ছুটে আসছে মানুষের ঢল, তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে। আবেগের ওম ছড়িয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা ঠায় বসে থাকতেও যাঁদের এতটুকু অসুবিধে হচ্ছে না!

Advertisement

[আরও পড়ুন: IPL নিলামে উঠছেন ৫৯০ জন ক্রিকেটার, মার্কি প্লেয়ারের তালিকায় ৪ ভারতীয়, নেই গেইল]

নামেই সুভাষ-স্মরণসভা। মঙ্গলবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে মঙ্গলবার যেটা হল, তা আদতে সুভাষের জীবন-স্মরণ। কে এলেন না? কারা বক্তব্য রাখলেন না? মন্ত্রী-আমলা থেকে শুরু করে ক্রিকেটার। গায়ক। ডাক্তার। সতীর্থ। ছাত্রকুল। কেউ বাদ যাননি। বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে বলে দিলেন, “ভারত অধিনায়ক থাকার সময় পিট সাম্প্রাসের সঙ্গে দু’দিন কাটিয়েছিলাম লন্ডনে। জেতার মাইন্ডসেটটা শিখতে। সুভাষদা’রও সেই মাইন্ডসেটটা ছিল।” রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এসেছিলেন অনুষ্ঠানে। ছিলেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। বিধায়ক দেবাশিস কুমার। তাপস রায়। সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী।

রূপঙ্কর বাগচি। সুভাষ-সুহৃদ ড: কৌশিক লাহিড়ী। মোহনবাগান সহ সচিব সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সমরেশ চৌধুরী। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। শ্যাম থাপা। ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। আইএম বিজয়ন। দেবজিৎ-বিজেন-আলভিটো-ষষ্ঠী অর্থাৎ, টিম আশিয়ানের অংশ। আর শুধু সাদামাটা স্মরণসভায় আটকে থাকেনি অনুষ্ঠান। সুভাষের বিস্ফোরক আত্মজীবনী ‘গোল’-এর আবরণ উন্মোচন হল। সুভাষ ভৌমিক স্মৃতি স্মারক চালু হল। পল্টু দাস ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকার চেক দেওয়া হল প্রয়াত সুভাষের পরিবারকে। এবং দেবজিৎ ঘোষ-রজত ঘোষদস্তিদারের সঙ্গে যৌথ পার্টনারশিপে গৌতম ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় চার-চার জন সুভাষ ভৌমিককে পাওয়া গেল অনুষ্ঠান জুড়ে।

ফুটবলার সুভাষ। কোচ সুভাষ। মানুষ সুভাষ। ম্যান ম্যানেজার সুভাষ। স্মৃতিচারণা করতে উঠে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য বলছিলেন, কী ভাবে সুভাষকে একটা ম্যাচে ট্যাকল করার পর কড়া গলায় তাঁকে ধমক দিয়েছিলেন অগ্রজ। বলেছিলেন, “শোন মনা, আমি কিন্তু মহম্মদ হাবিব নই।” শুনে কেঁপে যান মনোরঞ্জন। পরে সুভাষের সঙ্গে তাঁর ঝামেলার কথাও স্বীকার করলেন মনোরঞ্জন। “ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করব বলে ফোন করেছিলাম। গলা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাই। এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন,” বলে দেন তিনি। সত্যজিৎ আবার অনায়াসে স্মরণ করতে পারেন, সুভাষ মোহনবাগান কোচ থাকাকালীন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন তাঁর সঙ্গে। বিষয় একটাই– ফুটবল। আইএম বিজয়ন আমৃত্যু মনে রাখবেন, চার্চিল খেলার সময় অসাধারণ গোল করার পর প্রয়াত কোচের তাঁকে পুরস্কৃত করার কথা। এঁদের কারও কাছে সুভাষ সতীর্থ। কারও কাছে কোচ। কারও কাছে পিতৃসম। কারও কাছে অনুপ্রেরণা। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী যেমন বলে গেলেন, তাঁর গুরুই ছিলেন ময়দানের ‘ভোম্বল’। তাঁর কাছেই শিখেছেন স্পোর্টসম্যান স্পিরিট।

কিন্তু সুভাষের সতীর্থদের আবেগকে বোধহয় ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাঁর ছাত্রদের আবেগ। বিশেষ করে আশিয়ান টিমের সদস্যরা মঞ্চে ওঠার পর। বাইচুং ভুটিয়া-সুলে মুসা-মাইক ওকোরোরা সশরীর আসতে পারেননি। ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। বাইচুং বলেছেন, “আমার বন্ধু, কোচ, শত্রু সবই উনি ছিলেন।” ওকোরো বলে দেন, “ভাবতেই পারছি না, আমার বন্ধু আর নেই।” সুলে মুসা বলেন, “পরের জন্মে আমাদের আবার আমাদের দেখা হবে।” ষষ্ঠী দুলে বলার সময় আবার হাসির হুল্লোড় ওঠে তথাকথিত শোকসভায়। আশিয়ান স্মৃতিচারণের সময় যখন তিনি বলেন, “বেক তেরো সাসানার চাইম্যানকে আটকানো নিয়ে মিটিং চলছিল। স্যর বললেন, কে আটকাবে? বললাম, আমি। শুধু দু’টো শর্ত। ওর জার্সি নম্বরটা দিন আর আমাকে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা দিন!” ষষ্ঠী বলে যান, কিশোকুমারের মতোই চিরকাল হৃদয়ে থেকে যাবেন সুভাষ। কোচকে ঘিরে ছাত্রদের বেলাগাম আবেগ আরও টের পাওয়া যায় বিজেন সিং বলার সময়। “আমাকে উনি বলতেন, জোকার। কিন্তু আমি বিজেন হতামই না সুভাষ স্যর না থাকলে।” আলভিটো প্রায় ধরা গলায় বলে দেন, “ভাবতে পারেন, আমার ফিটনেস ঠিক করার জন্য আমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে রাখতেন সুভাষ স্যর?” দেবজিতের মুখ থেকে আবার প্রয়াত দিকপাল কোচের ম্যান ম্যানেজমেন্টের কাহিনিও শোনা যায়। একবার বাইচুংয়ের সঙ্গে ভাল ঝামেলা চলছিল সুভাষের। কথাবার্তা বন্ধ। ড্রেসিংরুমে বকাঝকাও করেন তারকাকে। কিন্তু ম্যাচে আবার সেই বাইচুংকেই ক্যাপ্টেন করে দেন! জেতার পর পরে দেবজিতকে তাঁর প্রয়াত গুরু বলেন, “যা চলছিল, আমাকে ডজ দিতে পারত বাইচুং। ক্যাপ্টেন করে কেমন ব্যাটাকে আটকে দিলাম!”

আর যত এ সব হয়, তত যেন চোখের সামনে সৃষ্টি হয় এক ধোঁয়াটে অবয়ব। রাশভারি কাঠামোয় তুলতুলে মন যাঁর। হাত গোটানো শার্ট পরে যে হেঁটে চলেছে দুলকি চালে, চিলতে হাসি নিয়ে, একটা সিগারেট ধরিয়ে। ইস্টবেঙ্গল মাঠ পেরিয়ে, ছায়াপথ ধরে। কল্পনার চরাচরে বাস্তবকে অবলীলায় মিশিয়ে। অনুষ্ঠান শেষ, সন্ধে পেরিয়েছে অনেকক্ষণ। সুরা-আহ্নিকের যে সময় হল। 

[আরও পড়ুন: মৃত্যু দেড় হাজারেরও বেশি আন্দোলকারীর! মায়ানমার নিয়ে চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট রাষ্ট্রসংঘের]

 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement