সব্যসাচী বাগচী: চোখে চশমা। চুল ধবধবে সাদা। শরীর সামান্য ভারী। ইনি বেশিক্ষণ হাঁটলে হাঁফিয়ে উঠতেন। উনি জানতেন না যে শেষবার মোহনবাগান আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। শেষ দিকে কিছু জানতে চাইলেই একটু রেগে বলে উঠতেন, ‘মুশকিল আচে!’ সেই মহম্মদ হাবিব এবার কালের নিয়মে ৭৪ বছরে চিরঘুমে চলে গিয়েছেন।
‘বড়ে মিঞা’-র আগে পরলোকে চলে গিয়েছিলেন ‘গুরু’ প্রদীপ বন্দ্যোাধ্যায়। ময়দান অবশ্য পিকে নামেই চেনে। গত বছর চোখ বুঝেছিলেন হাবিবের দুই সতীর্থ সুভাষ ভৌমিক ও সুরজিৎ সেনগুপ্ত। চলে গিয়েছেন তুলসীদাস বলরাম, নিখিল নন্দী। আর এবার ৭৭তম স্বাধীনতা দিবসের বিকেলে হায়দরাবাদে টলিচৌকির এলাকার নিজের আট বাই ছয় ছোট্ট ঘুপচি ঘর থেকেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন এক সময়ের ডাকাবুকো স্ট্রাইকার হাবিব।
শেষ কয়েকটা বছর একদম ভাল ছিলেন না। ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তি দুরারোগ্য স্নায়ুর রোগে ভুগছিলেন। যার মেডিক্যাল টার্ম পারকিনসন। ভাল-মন্দ স্মৃতি শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। খুব চাপ না দিলে, অতীতের অধ্যায়গুলো ঠিকঠাক তুলে ধরতে না পারলে, কাউকে সেভাবে চিনতেও পারেন না। অনবরত অসংলগ্ন কথা বলতেন। চলাফেরার শক্তিও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল। দিন যত এগিয়ে যাচ্ছিল ততই একটু একটু করে ‘বড়ে মিঞা’ যেন আরও অথর্ব হয়ে পড়ছিলেন।
অথচ এই হাবিবের সিলেবাসে একটা সময় ‘না’ শব্দের জায়গা ছিল না। ইনি তাঁর ‘মহাগুরু’-র মাস্টারপ্ল্যান পালটে দিয়েছিলেন। বড় ম্যাচে হাবিবের জন্যই ভাই মহম্মদ আকবরের পা থেকে সেই ঐতিহাসিক ১৭ সেকেন্ডের গোল এসেছিল। শুধু স্কিল নয়। সঙ্গে ছিল অধ্যবসায় ও নিয়মানুবর্তিতা। তাই এঁকেই ময়দানে ধরা হয় সংযম আর শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে এখনও ধরা হয়।
নিষ্ঠা নিয়ে সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন ফুটবলার হয়ে ওঠার তীব্র বাসনা, আকাঙ্খাকে অনেক দশক আগের হাবিব তাড়া করেছিলেন। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহমেডান অনেকবার পালটাপালটি করলেও যখন যে প্রধানের জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন, চূড়ান্ত সততায় সেই জার্সিকে নিজের মায়ের মতো সম্মান দিয়েছেন হাবিব। চরম পেশাদারিত্ব দেখিয়ে বছরের পর বছর প্রতিটা ম্যাচে হয়ে উঠেছেন দুর্বার।
ময়দানের এক এবং অনন্য নক্ষত্র। মাত্র ১৭ বছর বয়সে কলকাতা আসেন। তারপর থেকে দীর্ঘ ১৮ বছর তিনি ময়দানে খেলেছেন। ৯ বছরে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে গোল করেছেন ১১৩টি।
‘মিস্টার ফাইটার’ বলতে ভারতীয় ফুটবল বরাবর যাঁকে বোঝে, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বিতে সেই হাবিবের ১০টা গোল, আর ওই ১০টাই লাল-হলুদের হয়ে মোহনবাগান জালে পাঠানো। বিদেশি ক্লাবগুলোর বিপক্ষে হাবিবের লড়াকু খেলা আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসের পাতায়। ক্লাবে খেলার পাশাপাশি হাবিব একাধারে ১০ বছর ভারতের জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। ১৯৮০ সালে ‘অর্জুন পুরস্কার’ এবং ২০১৫ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ‘ভারত গৌরব’ সম্মান পান মহম্মদ হাবিব।
সেই হাবিব মোরাদনগরে মেহেদিপট্নমের আদিবাড়িতে দুই ফুটবলার দাদা আজম ও মইনের ক্যারিশমা দেখে ফুটবল খেলার প্রেমে পড়েছিলেন, অর্থের অভাবে কয়েক বছর আগে সেই বাড়ি বিক্রিও করতে বাধ্য হয়েছিলেন একসময় টগবগ করে ফুটতে থাকা স্ট্রাইকার।
হাবিবের ছেলে এম টেক। অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘ দিন উচ্চশিক্ষার খাতিরে ডনের দেশের নাগরিকত্ব পর্যন্ত রয়েছে হাবিব-পুত্রের। এখন জেড্ডায় নামী কম্পিউটর সংস্থার উঁচু পদে রয়েছেন। আকবরেরও এক ছেলে। এমএস। নিউইয়র্কের হাসপাতালে সার্জারি করেন। আকবর-পুত্র আবার আমেরিকান নাগরিক। সেখানেই ১০ দিন আগে চলে গিয়েছিলেন আকবর। জানতেন না যে, ৭৭তম স্বাধীনতা দিবসের বিকেলের দিকে এমন মন ভেঙে দেওয়া খবরটা শুনতে হবে।
এটাই ঘোর বাস্তব। যে ভাইকে নিজের হাতে মানুষ করেছিলেন। যার জন্য ময়দানে মহম্মদ আকবর নাম পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনিই এবার ‘ পিতৃসম’ দাদার জানাজা কাঁধে তুলতে পারবেন না! কিন্তু মহাগুরু পিকে, এক সময়ের সতীর্থ সুভাষ, সুরজিৎরা তো আছেন! এবার তারকাদের রিইউনিয়ন হবে। ‘বড়ে মিঞা’-কে নিয়ে জমে উঠবে ফুটবল আড্ডা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.