রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় ও সোহম দে: কাঁধের উপর ঝাঁপিয়ে আদর করা রাশি রাশি লম্বা চুল আজ আর নেই। দিন এগিয়েছে, বয়স বেড়েছে, লম্বা কেশরাশির জায়গা ক্রু কাট নিয়েছে এখন। লম্বা চুল কোথায় জিজ্ঞাসা করলে দিলখোলা হাসি আসে। দু’চারটে ইংরেজি শব্দ সঙ্গে, ‘‘থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ।’’
পারমা, লাজিও, ইন্টার, এসি মিলান, নামগুলো পরপর শুনলে কেমন যেন অভিভূত হয়ে পড়েন আজও। বোধহয় মনে পড়ে যায় কাতানেচ্চিও সিস্টেম। কার্লো আন্সেলোত্তি, ফ্রাঙ্কো বারেসিকে। আন্সেলোত্তি প্রথম কোচ ছিলেন তাঁর। বারেসির খেলা আবার দেখতেন খুব ভোরে উঠে। সেই বারেসির বিরুদ্ধেই পরে ফুটবলার হিসেবে নামা, একরাশ অবিশ্বাস সমেত। ‘‘উফ্, গত পঞ্চাশ বছরের সেরা সব ডিফেন্ডারদের সঙ্গে খেলে নিয়েছি আমি। কখনও বিপক্ষে। কখনও একসঙ্গে। কাকে ছেড়ে কাকে বাছবেন?’’ বলে অট্টহাসির আলোড়ন তোলেন দীর্ঘকায় আর্জেন্তিনীয়। শেষে সশ্রদ্ধ সংযোজন, ‘‘বারেসি, বারেসিই সেরা। ওর বিরুদ্ধে খেলা আমাকে স্ট্রাইকার হিসেবে অনেক উন্নত করেছে।’’
ব্রাজিল নামটা শুনলে নাকটা বেশ কুঁচকে যায়। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় অর্ধেক কলকাতা নীল-সাদা রংয়ে ঢাকা পড়ে শুনে যতটা সোৎসাহে ‘‘ইয়েস, ইয়েস আই নো’’ বলে ফেলেন, ঠিক ততটাই বিরক্ত দেখায় বাকি কলকাতা কোন টিমের দখলে যায় শুনে। ‘‘প্লিজ, ব্রাজিল নিয়ে আমি কিছু শুনতে চাই না। ব্রাজিলটা বাদ দিন,’’ অন্ধ সমর্থকের মতো নীল-সাদা রংয়ের বাইরে বর্ণান্ধ দেখায় ক্রু কাট চুলের ছয় ফুটকে। হার্নান ক্রেসপোর চুলের স্টাইল পাল্টে যেতে পারে। তাতে পাক ধরতে পারে। কিন্তু রক্তমাংসের হার্নান ক্রেসপো তো আজও বদলাননি।
ফুটবলার জীবনে অসম্ভব ক্ষিপ্রতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন ক্রেসপো। বিখ্যাত স্ট্রাইকার ভালদানোর নামের অনুকরণে তাঁকে লোকে ডাকত ‘ভালদানিতো’। কেউ আবার বলত, ‘এল পোলাসো।’ ক্রেসপোর ঠাকুমা পোলিশ ছিলেন, তাই। সে যাক। আসল হল, ক্রেসপোর টেকনিক, বল কন্ট্রোল, গোলক্ষুধা খুব কম সময়ের মধ্যেই তাঁকে কমপ্লিট স্ট্রাইকারের রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছিল। শুক্রবার সকালে মধ্য কলকাতার হোটেলে যে ক্রেসপোকে পাওয়া গেল, দেখলে বারবার মনে হবে ফুটবলার হার্নান ক্রেসপোরই সমাপ্তি ঘটেছে মাত্র। রাজকীয় মেজাজের নয়। একই ক্ষিপ্রতা, একই তীক্ষ্ণতা আছে, শুধু ফুটবলের বদলে এখন কথাবার্তায়।
হার্নান ক্রেসপো তো বলে দিলেন, বিশ্ব ফুটবলে আজ পর্যন্ত শুধু পাঁচ জন রাজা এসেছেন। এবং সেখানে কোনও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নেই! পেলে, ডি’স্টিফানো, জোহান ক্রুয়েফ, দিয়েগো মারাদোনা এবং লিওনেল মেসি! হার্নান ক্রেসপো বলে দিলেন, নিজেকে কিংবদন্তি প্রমাণ করতে লিওনেল মেসির বিশ্বকাপ জেতার কোনও প্রয়োজন নেই। ক্রুয়েফও তো বিশ্বকাপ পাননি। আরও বললেন, ব্যালন ডি’অর নিয়ে যতই হালফিলে নাচানাচি হোক। তাঁর কাছে ব্যালন ডি’অরের কোনও দাম নেই!‘‘বলছি না, ব্যালন ডি’অর গুরুত্বপূর্ণ নয়। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার কাছে নয়। ভাবিইনি কোনও দিন পুরস্কারটা নিয়ে,’’ বলছিলেন তিন বারের বিশ্বকাপার ক্রেসপো। আর বলতে বলতে ক্রেসপো কখন যে আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসের পাতা উলটোতে শুরু করলেন, খেয়াল থাকল না। ‘‘মারিও কেম্পেস, মারাদোনা, বাতিস্তুতা, মেসি, আমি নিজে, আগুয়েরো কী সব প্লেয়ার এসেছে আমাদের।’’ সর্বকালের সেরা আর্জেন্টিনা টিম তৈরি করতে হলে ফরোয়ার্ডে কোন দু’জনকে খেলাতেন?
শোনামাত্র প্রায় লাফিয়ে ওঠেন ক্রেসপো। ‘‘ফার্স্ট নামটাই আমার হবে! আমিই তো টিম করছি, নিজেকে রাখব না?’’ চারদিকে হাসির হুল্লোড় উঠতে ফের শুরু, ‘‘উপরে যাদের নাম বললাম, কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। বাতিস্তুতার সঙ্গে খেলেছি আমি। মেসির সঙ্গে খেলেছি। বাতিস্তুতা আর্জেন্তিনার সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার। মেসি আবার স্পেশ্যাল।’’ আর মারাদোনা? এবার চটজলদি উত্তর, ‘‘অন্য গ্রহের।’’
কথার স্রোতে তিনশো গোলের মালিক আরও নানান প্রসঙ্গে ঢুকে যান। ‘বাতিগোল’-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। বর্তমানের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বনাম তাঁর আমলের সেরি আ। আর্জেন্টিনার চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলস্কোরার(৩৫ গোল) ঢুকে পড়েন সব কিছুতে, সব বিষয়ে। অবলীলায়।
তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, এখন খেললে খেলতেন কোন ক্লাবে? য়ুরগেন ক্লপের লিভারপুলে? ‘‘না, না। গতির সঙ্গেই পাল্লা দিতে পারতাম না! সালাহ, সাদিও মানে, ফিরমিনো, উফ! আমি এখন খেললে খেলতাম মেসির সঙ্গে। বার্সেলোনায়। জীবনে কখনও লা লিগার দুই জায়ান্টের হয়ে খেলিনি। তবে মেসি না খেললে খেলতাম না।’’ ক্রেসপোর কথাবার্তার ভঙ্গিতেই ওঁত পেতে থাকে হাস্যরস। কিন্তু সিরিয়াসনেসও থাকে যখন বলেন, ‘‘ইপিএলই এখন সেরা। লা লিগা দুই। আমাদের সময় এক নম্বর ছিল সেরি আ।’’ আর অবশ্যই থাকে মহাতারকাচিত তাচ্ছিল্য। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো না মেসি কে বড় জানতে চাওয়ায় চোখমুখ কুঁচকে তো বললেন, ‘‘মেসি নিয়ে এত বলার পরেও এটার উত্তর দিতে হবে?’’
শহরে টাটা স্টিল ম্যারাথন উপলক্ষ্যে তিন দিনের জন্য এসেছেন ক্রেসপো। রবিবার ম্যারাথন। আর এ দিন বেশ কয়েকটা কাজও করলেন প্রাক্তন আর্জেন্টিনা স্ট্রাইকার। দুপুরের দিকে চলে গেলেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে। নিজের সই করা আর্জেন্টিনা জার্সিও ক্রীড়ামন্ত্রীকে উপহার দিলেন। শোনা গেল, ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তার সময় বাংলায় মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল ডার্বি নিয়ে জানতে পারেন ক্রেসপো। শুনেটুনে নাকি বলেন যে, তাঁর ডার্বি সম্পর্কে ধারণা ভালই আছে। কারণ তাঁর দেশে রিভারপ্লেট বনাম বোকা জুনিয়র্স নিয়ে কম উত্তেজনা ছড়ায় না। এটাও জানা গেল, আগামী রবিবার ম্যারাথনের দিন ক্রেসপোর পরের দিকে যুবভারতী যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। ক্রীড়ামন্ত্রীও নাকি থাকবেন সেই সময়। পরে অরূপ বলছিলেন, ‘‘ছোট থেকেই আমি ব্রাজিল ভক্ত। তবে ক্রেসপোর খেলাও খুব ভাল লাগত। তিনশো গোল করা বিশ্বকাপার এখানে এসেছে। ভারতীয় ফুটবল নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। কলকাতা দেখে অভিভূত হয়েছে। এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে?’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.