অরিঞ্জয় বোস: প্রিয় মেসি,
আপনি চললেন মায়ামিতে। এ কেবল নিছক একটি তথ্য মাত্র নয়। হয়তো এ আসলে ফুটবল-বিশ্বে এক মহাদেশের আধিপত্য শেষেরই ইঙ্গিত। ইউরোপের শামিয়ানা থেকে বেরিয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo), বেঞ্জেমার মতোই আপনাকেও শেষমেশ বেছে নিতে হল অন্য মহাদেশের ময়দান। ছাড়তে হল আপনার স্বপ্নের বাগানকে, যেখানে একদা দিনের পর দিন ফুল ফুটিয়েছিলেন আপনি। আপনাদের এই চলে যাওয়া যে গ্রহান্তরের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে আরব বা আমেরিকার ফুটবল কতটা পুষ্টি পাবে সে তো অনেক পরের কথা। কিন্তু আপনার এই সিদ্ধান্ত অন্তত একটা কথা স্পষ্ট করে দিল যে, তারকাদের সিদ্ধান্ত তাঁদের নিজস্ব। তা নিয়ে অযথা দড়ি টানাটানি করে লাভ নেই। লাভ নেই কটূক্তি করেও।
অথচ এই কটূক্তিই একদিন ধেয়ে এসেছিল আপনার সমর্থকদের দিক থেকে। লক্ষ্য ছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। তিনি যেদিন সৌদিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, সমালোচনার অজস্র চোখা বাণ তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন আপনার একান্ত অনুগামীরা। যার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, রোনাল্ডো নামক মহাজাগতিক ঘটনাটিকে নেহাত ছেঁদো, বালখিল্য প্রমাণ করা।
আপনাদের মতো প্রতিভা যে এই পৃথিবীটাকে দু-ভাগে ভাগ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, এ নিয়ে বিশ্বের আর কোনও ফুটবলপ্রেমীর মনেই কণামাত্র সন্দেহ নেই। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে আপনাদের দ্বৈরথ বছরের পর পর বছর যে আখ্যানের জন্ম দিয়েছে, তাকে আধুনিক ফুটবলের মহাকাব্য বলে অত্যুক্তি হয় না। কয়েক প্রজন্ম ধরে ফুটবলপ্রেমীরা এই দুই গোলার্ধের অমোঘ চুম্বকে আটকা পড়েছেন। আর হরিৎক্ষেত্রে আপনারা যত শিল্পের ফুল ফুটিয়েছেন ততই কুরুক্ষেত্র ঘনিয়ে উঠেছে সমর্থকদের মধ্যে। এ-কথা ঠিক যে, বাইশ জন ফুটবলার শুধু নন, ফুটবল নামক স্বপ্নটাকে টাটকা-জ্যান্ত করে রাখেন সমর্থকরাই। তাঁদের আবেগ, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের রক্তক্ষরণেই ফুটবল নব্বই মিনিট পেরিয়ে ঢুকে পড়ে মহাকালের রথচক্রে। মাঠের খেলা ফুরোলেও তাই সমর্থকদের অন্তরমহলে খেলা চলতেই থাকে। আর যে সময়ে আপনাদের মতো সর্বগ্রাসী দুই মহামানুষ একই সঙ্গে অবস্থান করেন, সেই সময়টার মহাভারত যে অন্যভাবে লেখা হবে, তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে!
অতএব বার্সা বনাম রিয়ালের দিনরাত্রি ক্রমশ ঢুকে পড়ল মিথের সাম্রাজ্যে। তারপর দিন বদলাল। সেদিনের তরুণ তুর্কি সমর্থকদের বয়স বাড়ল। বনস্পতির ছায়া দেওয়া আপনারাও ক্রমে বৃদ্ধ হলেন। অর্জনের শীর্ষ ছুঁয়েও এই বেলাশেষে আবার আপনাদের বেলাশুরু। সেই শুরুর চিহ্ন রেখেই রোনাল্ডো যখন পা বাড়ালেন সৌদি আরবের সিকে, তখন নিন্দার হলাহল যেন উথলে উঠল। তার বেশিরভাগটাই এল আপনার নাম চিহ্নিত সমর্থকদের গোলার্ধ থেকে। সিআর সেভেনের দিকে সেদিন আঙুল তুলে বলা হয়েছিল, বুড়ো ঘোড়া আর দৌড়াতে না পেরে সৌদিতে আশ্রয় নিচ্ছেন। আর দ্বিতীয় অভিযোগটা আরও মারাত্মক, নেহাতই টাকার লোভে রোনাল্ডো হেলাফেলা করলেন তাঁর অগণিত ভক্তের আবেগ। অবশ্য ক্রিশ্চিয়ানোর পৃথিবীর বাসিন্দারা সেদিন জবাব দেননি। মনকেমন বুক চেপে তাঁরা চুপ করেই ছিলেন। আর মনে মনে বলেছিলেন, আর একটিবার রিয়ালে ফিরলে কী ভালই না হত!
সময়ের কালচক্রে আপনি আর আপনার সমর্থকরাও ইতিহাসের সেই একই বাঁকে দাঁড়িয়ে। শোনা যাচ্ছিল, আপনি বার্সায় ফিরবেন। কিন্তু সে ফেরায় নাকি অহেতুক জটিলতা তৈরি হবে। বার্সার এখনকার বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের বেতনে কাটছাঁট হতে পারে। আরও পদ্ধতিগত সমস্যা আছে। ফলত একদা যেমন চোখের জলে বার্সা-বিদায় হয়েছিল, সে দৃশ্যের আর পুনরাবৃত্তি চাইছেন না আপনি। বার্সা ছাড়া ইউরোপের অন্য ক্লাবকেও আর বেছে নেননি। তাই পাড়ি জমালেন অন্য মহাদেশে। আপনার ভক্তরা যথারীতি ক্ষুণ্ণ। মেসি আর বার্সার সমীকরণ মনে মনে প্রায় মিলিয়েই ফেলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু কে না জানে, সময়ের থেকে বড় রসিক আর কেউ নেই! আর তাই সেদিন রোনাল্ডোর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া সকল অসম্মান আজ যেন প্রহসন হয়েই ঝরে পড়ল আপনার সমর্থকদের উপর।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে বছরের পর বছর শীর্ষে থেকে পারফর্ম করে যাওয়া যে কী অতিমানবিক ব্যাপার, তা আপনি জানেন। আর আপনি মেসি (Lionel Messi) বলেই জানেন, রোনাল্ডো নামক বিস্ফোরণের মাহাত্ম্য! সেই রোনাল্ডোর দিকে যখন অপমান, কটূক্তি ধেয়ে এসেছিল আপনার সমর্থকদের তরফ থেকে, রোনাল্ডো-ভক্তরা সেদিন চুপ করেই ছিলেন। রক্তক্ষরণ তাঁদের কম হয়নি। এক জীবনের একটা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের জন্য সারা জীবনের কৃতিত্ব তো মুছে যায় না। যেমন আপনার মায়ামিতে যাওয়ার জন্য মুছে যাচ্ছে না আপনার পূর্ববর্তী সমস্ত অর্জন। অথচ আপনার সমর্থকরা সেদিন এই সাধারণ কথাটিই বুঝতে চায়নি। খেলার মাঠের বিরোধিতার একটা আলাদা মাহাত্ম্য আছে। কিন্তু সেই বিরোধিতার রেশ যদি কারও ব্যক্তিজীবনকে রক্তাক্ত করে, তবে তা কোনওভাবেই কাম্য নয়। অথচ সেদিন রোনাল্ডোকে ছোট করতে ঠিক এতটাই ব্যস্ত ছিলেন আপনার সমর্থকরা যে, তাঁরা বুঝেও উঠতে পারেননি যে, একদিন একই নিয়তি প্রহসন হয়ে ফিরে আসবে তাঁদের কাছে।
আজ আপনি যখন গ্রহান্তরের পথে, তখন আপনার সমর্থকরাই আপনাকে তুলেছে কাঠগড়ায়। তাঁদের প্রশ্ন ক্রুশবিদ্ধ করছে আপনাকে। প্রিয় মেসি, আমরা, রোনাল্ডো সমর্থকরা আজ কিন্তু আপনাকে কটূক্তি করছি না। কেননা আমরা জানি, নীরবতাও আসলে এক শিল্পিত সৌজন্য। হয়তো আজ আপনার সমর্থকরাও বুঝতে পারছেন, মহাতারকাদের মহাকাশ থেকে টেনে নামানো যায় না। আর যদি সে চেষ্টা হয়, তবে সেই আগুনে পুড়তে হয় নিজেদেরই। ঠিক যেমন এখন হৃদয়ে মহাকালের ছেঁকা খাচ্ছেন আপনার সমর্থকরা।
আমরা রোনাল্ডো-ভক্তরা আর কী করতে পারি! বড়জোর প্রার্থনা করতে পারি, আপনার মায়ামি সফর মায়াময় হয়ে উঠুক আপনার সমর্থকদের কাছেও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.