সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো পারেননি। পারেননি নেইমারও। কিন্তু তিনি এখনও বহাল তবিয়তে টিকে আছেন।ক্রোয়েশিয়াকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে দিয়েগো মারাদোনার কক্ষপথের আরও কাছে লিওনেল আন্দ্রেজ মেসি (Lionel Messi)। খর্বকায় ১০ নম্বর জার্সিধারীর সামনে বিশ্বকাপ দেশে নিয়ে যাওয়ার আরও একটা সুযোগ।
বর্ণময় ফুটবল জীবনের শেষ বিশ্বকাপ (FIFA World Cup)। শেষটা রাঙিয়ে দেওয়ার শপথ নিয়েই কাতারে হয়তো এসেছিলেন ‘এলএম ১০’। চা পানের সময় পেয়ালা আর ঠোঁটের মধ্যে যে দূরত্ব থাকে, এক্ষেত্রেও তাই রয়ে গিয়েছে। এখনও ফাইনালের বলই গড়ায়নি। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে এই পারফরম্যান্সের পরে দেশবাসী স্বপ্ন দেখতেই পারেন। চারবছর আগে এই ক্রোয়েশিয়ার কাছেই ৩-০ গোলে হারতে হয়েছিল নীল-সাদা জার্সিধারীদের। সেই লজ্জাজনক হারের প্রতিশোধ কাতারে নিল আর্জেন্টিনা।
বুয়েনোস আইরেসে নতুন এক ভোর আনতে চান মেসি। কাটাতে চান কাপ-খরা। সেই কবে ১৯৮৬ সালে দিয়েগো মারাদোনার (Diego Maradona) হাত ধরে বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। তার পর থেকে প্রতিবার দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বকাপে যায় নীল-সাদা জার্সিধারীরা। আর প্রতিবারই চোখের জলে বিদায় নিতে হয়।
২০০৬ থেকে বিশ্বকাপ খেলছেন মেসি। এবার নিয়ে পঞ্চমবার। রোজারিওর ছেলে কি পারবেন কাপ নিয়ে যেতে? এদিন রেফারির শেষ বাঁশির পর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে জোর চর্চা। চলছে কাউন্টডাউন। মাঝে কেবল একটা স্টেশন–ফাইনাল। আর সেখানে বিজয়কেতন ওড়াতে পারলেই দীর্ঘদিন ধরে চলা যাবতীয় বিতর্কের অবসান ঘটে যাবে। মেসির ওই বাঁ পা কথা বলেছে লুকা মদ্রিচদের বিরুদ্ধে। বিরতির ঠিক আগের মুহূর্তটাই ধরা যাক। তিন জন ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড় ঘিরে ধরেছেন মেসিকে। কিন্তু তার মধ্যে দিয়েও মেসি ম্যাজিক দেখিয়ে গেলেন। তিনি যে ধরাছোঁয়ার বাইরের এক জগতের প্লেয়ার! আলভারেজের জন্যই পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। মেসি্র সামনে লিভাকোভিচ। এর আগে ক্রোট গোলকিপার লিভাকোভিচ টাইব্রেকারে থামিয়ে দিয়েছেন জাপান ও ব্রাজিলের দৌড়। ফুটছেন তিনি। কিন্তু তাঁর পক্ষে কি বিশ্বসেরা খেলোয়াড়কে থামানো সম্ভব? মেসি পেনাল্টি নিলেন একটু জোরের উপর। এমন এক কোণে বলটা রাখলেন যেখানে লিভাকোভিচ শরীর ছুঁড়েও পৌঁছতে পারেননি।
লুকা মদ্রিচকে দেখা গেল নিজেদের পেনাল্টি বক্সে নেমে রক্ষণকে সাহায্য করছেন। মেসি নাকি রক্ষণে সাহায্য করেন না, তিনি থাকা মানে প্রতিপক্ষ সবসময়ে সুবিধা পায়। এগারো বনাম দশের খেলা চলে। ডাচরা এই থিওরি কীভাবে আবিষ্কার করেছেন, তা তাঁরাই ভাল বলতে পারবেন। তার জন্য মেসি অবশ্য শিক্ষা দিয়েছেন ফ্যান গালদের। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে আর্জেন্টাইন রাজপুত্র নিজেদের ডিফেন্সিভ থার্ডে নেমে বল কেড়েছেন। তারপরে এমন ভাবে বল শিল্ড করেছেন, কার সাধ্যি তা কাড়া! ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়রা শক্তিশালী। কোভাচিচ, ব্রোজোভিচরা শারীরিক শক্তি দিয়েও এক খর্বকায় দশ নম্বরের পা থেকে বল কাড়তে পারছেন না। স্বর্গীয় এক অনুভূতি এনে দেয় এই দৃশ্য । শুধু তাই নয়, দ্বিতীয়ার্ধে ওয়ান-টু খেলে প্রায় গোল করে ফেলেছিলেন ‘এলএম ১০’। এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। আলভারেজ জোড়া গোল করলেন। দ্বিতীয় গোলের পাসটা তো এল সেই মেসির পা থেকেই। ডান দিক থেকে ওরকম মসৃণ দৌড়। এঁকে বেঁকে ক্রোয়েশিয়ার পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়ে আলভারেজকে যে বলটা বাড়ালেন, সেখান থেকে যে কেউ গোল করবেন। আলভারেজ পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজটা করলেন। ছুটে গেলেন মেসির কাছে। জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। ওই গোলটা তো মেসিই বানিয়ে দিলেন তাঁর জন্য। লিভাকোভিচকে দেখে খারাপ লাগারই কথা। কী করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না।বাঁ পা দিয়ে রূপকথা লিখে গেলেন রাজপুত্র। এর পরেও কি আর সমালোচনা চলে!
সমালোচনা, ধিক্কার, নিন্দা নতুন নয় লিও মেসির কাছে। অতীতে বহুবার নিন্দুকরা রক্তাক্ত করেছেন মহাতারকাকে। একসময়ে স্থিরই করে ফেলেছিলেন জাতীয় দলের জার্সিতে আর খেলবেন না। পরে সিদ্ধান্ত বদলে ফিরে আসেন। ভাগ্যিস তিনি ফিরে এসেছিলেন। নাহলে আজকের এই রাতের দেখা কি মিলত?
কথায় বলে, দুই প্রজন্মের মধ্যে কোনও তুলনা হয় না। মেসি আর মারাদোনা দুই ভিন্ন সময়ের প্রতিনিধি। তবুও মেসিকে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে ফেলে কাটাছেঁড়া করা হত। বার্সার জার্সিতে ছ’ জন বিপক্ষের ফুটবলারকে মাটি ধরিয়ে গোল করেছিলেন মেসি। প্রবল ভাবে তুলনায় চলে এসেছিল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার করা শতাব্দীর সেই সেরা গোল। সবাই বলতেন, মারাদোনা একটা বিশ্বকাপ পেয়েছেন। মেসি একটিও পাননি। বিশ্বকাপ জয়ই তো ফুটবলের শেষ স্টেশন। সেই স্টেশনে পৌঁছতে না পারলে তুমি কীসের বিশ্বসেরা হে! নিন্দুকদের জবাব দেওয়ার আরও একটা সুযোগ পাচ্ছেন মেসি। সেই সুযোগ কি তিনি হাতছাড়া করবেন এবার?
২০১৪ বিশ্বকাপে মারাকানা স্টেডিয়ামে স্বপ্ন ভেঙেছিল লিওনেল মেসির। জার্মানির গোলকিপার ম্যানুয়েল ন্যয়ার যখন বিশ্বকাপ হাতে নেওয়ার জন্য যাচ্ছেন, মেসির সেই শূন্য দৃষ্টি বলে দিচ্ছিল তাঁর যন্ত্রণা, কষ্ট, হতাশার কথা। ফুটবল-ঈশ্বর হয়তো মেসির কষ্ট সহ্য করতে পারেন না। তাই আরও একটা সুযোগ দিলেন। নাহলে চিরকালের ট্র্যাজিক নায়ক হয়েই যে থাকতে হত তাঁকে। দেশে তাঁকে নিয়ে আরও একবার ঝড় উঠত। বলা হত, ভাল প্লেয়ার কিন্তু বিশ্বকাপ জিততে পারেনি।
রবিবার রাতে আরও একবার মেসি-ঝলকানি দেখতে চায় গোটা বিশ্ব। মারাদোনাও কি চাইছেন না! দু’ বছর হয়ে গিয়েছে এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে মারাদোনা চলে গিয়েছেন অন্য এক ভুবনে। সেখান থেকে মারাদোনা নজর রাখছেন মেসির উপরে, আর্জেন্টিনার উপরে। এমন বিশ্বাস মারিও কেম্পেসের দেশের মানুষের। বিশ্বকাপের বল গড়ানোর আগে হর্হে বুরুচাগা বলেছিলেন, ”লিও, এবার অন্তত দিয়েগোর জন্য কাপটা জেতো।”
লুকা মদ্রিচ ও তাঁর মহাকাব্যিক লড়াইয়ের শেষে চোখে জল ক্রোয়েশিয়ার মায়েস্ত্রোর। এই ৩৭-এও তিনি জাদু দেখিয়েছেন। মেসি তাঁর থেকে দু’ বছরের ছোট। ৩৫-এর মেসি চোখের আরাম, মনের শান্তি। তিনি আগের থেকে অনেক পরিণত। এই মেসি সেই অল্প বয়সের জাদুকর নন, যিনি চক্রব্যূহে ঢুকতে জানেন কিন্তু বেরনোর পাসওয়ার্ড জানেন না। অভিজ্ঞতা তাঁকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের হিংস্র পা চালানো তাঁকে রক্তাক্ত করতে পারে কিন্তু তাঁর বাঁ পাকে থামাতে পারেনি। আবেগঘন এই উত্তাল রাতে মেসির কাছে আর্জেন্টাইনদের একটাই অনুরোধ, আর একবার জ্বলে ওঠো মেসি। আর একবার।নতুন এক ভোরের কাউন্টডাউন যে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে বুয়েনোস আইরেসে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.