সব্যসাচী বাগচী: ১৬ আগস্ট। স্বাধীনতা দিবসের পরের দিনটা বঙ্গ ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বড্ড মন খারাপের। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্টের দিনে ইডেন গার্ডেন্সের মেগা ডার্বি রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল, কলকাতা লিগের ডার্বি ম্যাচকে কেন্দ্র করে যে মর্মান্তিক দূর্ঘটনা ঘটেছিল, তার ৪৩ বছর পূর্তির ‘কালো দিন’। সেই দুপুরে অকালে ঝরেছিল ১৬টি তাজা প্রাণ। আহতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর।
যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন নয়। সেই সময় দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মর্যাদার ‘বড় ম্যাচ’ ইডেনে আয়োজিত হত। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ছিল না। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশকে ফুটবলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাঙালি আবেগ ছিল অপরিমেয়। সেইসঙ্গে ফুটবলকে কেন্দ্র করে হিংসাত্মক ঘটনার সংখ্যা ও সম্ভাবনা উভয়েই বাড়ছিল। ১৯৭০-এর দশকের প্রথম পর্যায়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও তার থেকে উদ্ভুত সামাজিক হতাশা ১৯৭০-এর দশকের শেষে এবং ১৯৮০-র দশকের শুরুর দিকেও কিছুটা বজায় ছিল। ফলে যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে যে উত্তেজনা ছিল তার বহিঃপ্রকাশ অনেক সময় ঘটে যেত ফুটবল মাঠে। নিজের প্রিয় দলের প্রতি সমর্থনে ও বিপক্ষ দলের প্রতি বিরূপতায়। যার থেকে ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকেই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল এবং ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান ম্যাচকে কেন্দ্র করে এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতির সাক্ষী থাকত কলকাতা ময়দান।
সেই কুখ্যাত ডার্বিতেও তেমনই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধের ১২ মিনিটে সবুজ-মেরুনের বিদেশ বসু ও লাল-হলুদের দিলীপ পালিত একে অন্যের সঙ্গে রীতিমতো শারীরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। আর মাঠের সেই ঝামেলার রেশ ছড়িয়ে যায় গ্যালারিতে। সেই আগুনে পরিস্থিতি আর সামলানো যায়নি। যদিও রেফারি সুধীন চট্টোপাধ্যায় যথেষ্ট কড়া হাতেই খেলা পরিচালনা করছিলেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিদেশ বসু ও দিলীপ পালিত, দু’জনকেই লাল কার্ড দেখিয়ে মার্চিং অর্ডার দেন। যদিও দুই দলের কিছু উন্মত্ত সমর্থকদের জন্য গ্যালারির উত্তেজনা ততক্ষণে চরম আকার নিয়েছে। মানুষের মধ্যে রোষ এতটাই নৃশংসতার রূপ নিয়েছে যে বিপক্ষ দলের সমর্থককে গ্যালারি থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও কোনওরকম কুণ্ঠাবোধ হয়নি!
এদিকে এটা ভুলে যাবার মতো নয় যে ইডেন আসলে ক্রিকেট মাঠ। এর বাইরে যাবার পথও অনেক সংকীর্ণ। কলকাতা পুলিশ এই সময় জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। আতঙ্কিত জনতা একসঙ্গে সেই সরু বাহির পথ দিয়ে বেরোতে গেলে অনেকেই পদপৃষ্ঠ হয়ে প্রাণ হারান। এই দূর্ঘটনায় মোট ১৬ জন নিহত হন এবং গুরুতরভাবে আহত হন সংখ্যায় অনেক বেশি মানুষ।
ঘটনার পরদিন সংবাদপত্র গুলিতে খবরের সঙ্গে যে ছবি বেরোয় তাতে সাধারণ মানুষ আরও শিহরিত হয়ে ওঠে। সংবাদপত্রের শিরোনামে উল্লিখিত হয় যে এই দূর্ঘটনার জন্য দায়ী ফুটবল খেলাই। কিন্তু এই ঘটনার প্রভাব হয় সূদূরপ্রসারী। সাধারণ বাঙালি সমাজে ফুটবল খেলাই এক ভীতিপ্রদর্শনকারী হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে ফুটবল ছিল বাঙালির প্রাণের খেলা। বাঙালির সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের যাত্রাপথে এই ১৬ আগস্ট, ১৯৮০-র মর্মান্তিক ঘটনার পরই প্রথমবারের জন্য বাঙালি মধ্যবিত্তের হৃদয়ে ফুটবল খেলা সম্পর্কে ভয় ও আশঙ্কার উদ্রেক হয়।
শুধু ফুটবল খেলাই নয় বাড়ির অভিভাবকরা ছোট ছোট ছেলেদের ফুটবল মাঠ থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে সচেষ্ট হয়ে পড়েন। এর প্রভাব পড়ে বাঙালির ফুটবল চর্চা ও ফুটবল সংস্কৃতির উপর। ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে কলকাতা ফুটবলে স্থানীয় প্রতিভার উত্থানের অভাব রীতিমতো লক্ষ্যনীয়।
এদিকে ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের মাঠে কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতের বিশ্বজয়ী হয়। এর দুই বছর পর ১৯৮৫ সালে বেনসন এন্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড সিরিজ প্রতিযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সুনীল গাভাসকরের নেতৃত্বে ভারত সিরিজ জিতে যায়। সেই দুই মেগা ইভেন্টে জয় ভারতের অন্যান্য প্রান্তের মানুষের মত বাঙালিকেও অনেক বেশিমাত্রায় ক্রিকেট মুখী করে তোলে। যার ফলে আক্ষরিক ক্ষতি হয় বাংলার ফুটবল সংস্কৃতির।
কিন্তু বাঙালির সাময়িক ফুটবল বিরূপতার প্রধান কারণ ছিল ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্টের মর্মান্তিক দূর্ঘটনা। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও এই ঘটনার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বিশেষত মতি নন্দীর লেখা উপন্যাস ‘ফেরারি’ ও মান্না দে-র গাওয়া গান ‘খেলা ফুটবল খেলা’-র মধ্য দিয়ে। অনেক ফুটবলপ্রেমী বাঙালি এই ঘটনার দ্বারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বা বিতশ্রদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানানোর ভাষা হিসাবে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখা চিরতরে ছেড়ে দেন।
পরবর্তী সময় এই বিশেষ দিনটিকে ‘ফুটবল শহিদ দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সেই ১৬ জন ফুটবলপ্রেমীর স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে। আসলে ৪৩ বছর পরেও ১৬ আগস্ট, ১৯৮০ সালের ঘটনা বাঙালি ক্রীড়া সংস্কৃতি ও সামাজিক মননে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। এই ঘটনা আমাদের অনেক বড় শিক্ষা দিতে গেছে। মাঠের পরিবেশ আর রণক্ষেত্র কখনও এক হতে পারে না। খেলার প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবেগ অনেক নিয়ন্ত্রিত ও পরিশীলিত হওয়া উচিত সেই শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে সেই মন খারাপ করা ঘটনা।
সর্বোপরি খেলার মাঠের স্পোর্টসম্যানশিপ যে শুধু খেলোয়াড়দের মধ্যেই নয়, দর্শকদের মধ্যেও একইভাবে প্রয়োজন সে’কথা প্রমাণ করে দিয়ে যায় সেই মর্মান্তিক দূর্ঘটনা। পরবর্তী সময়ে কলকাতা ফুটবলে দর্শক হিংসার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ নির্মূল না হলেও অনেকাংশেই যে কমেছে সেকথা বলাই বাহুল্য। আবার সোশ্যাল মিডিয়ার ভরা বাজারে সেই চরম আবেগের বহিঃপ্রকাশ অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। দূর্ঘটনার ৪৩ বছর পূর্তিতে একটাই প্রার্থনা সেই দিন যেন আর কখনও না ফিরে আসে।
১৬ই আগস্ট, ১৯৮০-র ইডেনে ১৬ জন ফুটবল শহীদের নাম:
১) হিমাংশু শেখর দাস
২) উত্তম ছাউলে
৩) কার্তিক মাইতি
৪) সমীর দাস
৫) অলোক দাস
৬) সনত বসু
৭) বিশ্বজিৎ কর
৮) নবীন নস্কর
৯) কার্তিক মাঝি
১০) ধনঞ্জয় দাস
১১) প্রশান্ত কুমার দত্ত
১২) শ্যামল বিশ্বাস
১৩) অসীম চ্যাটার্জী
১৪) রবিন আদক
১৫) মদন মোহন বাগলি
১৬) কল্যাণ সামন্ত
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.