কার্লেস কুয়াদ্রাত ও তাঁর ভাই জোয়ান অ্যালবার্ট কুয়াদ্রাত। ছবি জোয়ানের সৌজন্যে।
কৃশানু মজুমদার: স্পেনের সারভেরা থেকে ভুবনেশ্বরের দূরত্ব কত? গুগল সার্চ ইঞ্জিন বলছে, আট হাজার আশি কিলোমিটার। দূরত্ব যাই হোক না কেন, রবিবার কলিঙ্গ সুপার কাপ ফাইনালে শারীরিকভাবে উপস্থিত না থেকেও ভুবনেশ্বরে থাকবেন কার্লেস কুয়াদ্রাতের (Carles Cuadrat) ভাই জোয়ান অ্যালবার্ট কুয়াদ্রাত।
সুদূর কাতালুনিয়া প্রদেশের ছোট্ট শহর সারভেরা থেকে দাদার সমর্থনে গলা ফাটাবেন ইস্টবেঙ্গল (East Bengal) হেডস্যরের ভাই-বোনেরা। সুপার কাপের কঠিন ফাইনালের আগে দাদা কার্লেস কুয়াদ্রাতের জন্য ভাই জোয়ানের বার্তা, ”কার্লেস, কাতালুনিয়ায় তোমার দল তোমার জন্য প্রার্থনা করবে, ম্যাচের প্রতিটি সেকেন্ডে তোমার সঙ্গে রয়েছি আমরা। এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ থাকবে না আমাদের সমর্থন। এগিয়ে চলো কার্লেস।”
কুয়াদ্রাতের কোচিংয়ে চলতি মরশুমে দ্বিতীয়বার ফাইনাল খেলতে নামছে ইস্টবেঙ্গল। ট্রফি জয়ের হাতছানি লাল-হলুদ ব্রিগেডের সামনে। দীর্ঘ দিনের ট্রফি ক্ষরা কাটানোর মোক্ষম সুযোগ। ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের সামনে আরেক স্পেনীয় কোচ সের্জিও লোবেরার ওড়িশা এফসি। দারুণ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে লাল-হলুদের হেডস্যর কার্লেস কুয়াদ্রাতও। ইতিমধ্যেই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের হৃদয় জিতে নিয়েছেন তিনি। মহানদীর তীরে কুয়াদ্রাত রূপকথা তৈরি হবে কিনা তার উত্তর দিয়ে যাবে রবিসন্ধের ৯০ মিনিট। মেগা ফাইনালের আগে ভাই জোয়ান বলছেন, ”ইস্টবেঙ্গলের সাফল্যের পিছনে আমার দাদার অবদান থাকবে, এটা ভাবতেও অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। কার্লেসের কাছে ইস্টবেঙ্গলের অনেক গল্প শুনেছি। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্য আমি গর্ববোধ করছি। পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমি থাকি, ওদের জন্য আমার পুরোদস্তুর সমর্থন থাকবে।”
জোয়ানের কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, দাদা কার্লেসের কাছে ইস্টবেঙ্গলের লড়াই-সাফল্যের গল্প শুনেই তিনি লাল-হলুদের সমর্থক হয়ে গিয়েছেন। লাল-হলুদের সাফল্য তাঁক আনন্দ দেয়, প্রশান্তি এনে দেয় মনে। প্রিয় দল জিতলে এই অনুভূতি যে হয় সব সমর্থকদেরই। ইস্টবেঙ্গল হেডকোচের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতির সরণী ধরে জোয়ান হাঁটা লাগান সেই ফেলে আসা ছেলেবেলায়। নস্টালজিয়া গ্রাস করে তাঁকে। জোয়ান বলছেন, ”অনেক গল্প মনে পড়ছে। আমাদের ঘরের ওই বারান্দায় বসে তাস খেলতাম কার্লেসের সঙ্গে। নতুন নতুন খেলা শিখতাম। ঘরের ভিতরে মোজা দিয়ে বল বানিয়ে আমরা ফুটবল খেলতাম। খেলতে খেলতে শো কেসের কাচ ভেঙেও ফেলেছি আমরা।”
জোয়ানের কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এ তো আমাদেরই ঘরের কথা। বাংলার ঘরেও হুবহু এক ছবি দেখা যায়। ফুটবল সব দেশেই বোধহয় একই ছবি এঁকে দিয়ে যায়।
একসময়ের ফুটবলার কার্লেস এখন প্রতিষ্ঠিত কোচ। তাঁর হাতে ওই জাদুদণ্ড। হারতে হারতে তলানিতে চলে যাওয়া এক দলকে আবার বাঁচিয়ে তুলেছেন স্প্যানিশ মায়েস্ত্রো। জেতার স্বাদ পাচ্ছেন সমর্থকরা। নতুন স্বপ্ন এসে ভিড় জমাচ্ছে সমর্থকদের চোখে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই দাদার এই সাফল্যে এতটুকুও অবাক নন জোয়ান। তিনি বলছেন, ”কার্লেস আমাদের ভাই-বোনেদের কাছে সবসময়েই রোল মডেল, আমাদের প্রেরণা। একটা দলকে এককাট্টা করে রাখা,পরিবার করে তোলার দারুণ এক গুণ রয়েছে দাদার মধ্যে। আমাদের পরিবারকেও এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে কার্লেস। লিডার বলতে যা বোঝায়, কার্লেসও তাই।” সমর্থকদের গলায় জোয়ানেরই প্রতিধ্বনি। তাঁরা বলে থাকেন, এই ইস্টবেঙ্গল দলের চালিকাশক্তি কার্লেস কুয়াদ্রাতই।
দুই ভাইয়ের পেশা ও নেশা ভিন্ন। কার্লেসের শয়নে, স্বপনে, জাগরনে ফুটবল। জোয়ানের আবার ধ্যান-জ্ঞান বাস্কেটবল। দাদার মতোই কোচ হিসেবে সাফল্য রয়েছে ভাইয়েরও। জোয়ান বলছেন, ”স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বাস্কেটবলের প্রতি আকর্ষণ বোধ করি। ঘরে আমার দুই ভাই ফুটবল খেলত। আর বাকি দুই ভাই আমরা বাস্কেটবলে চলে এসেছিলাম। ১৮ বছর বয়সে আমি কোচিংয়ে চলে আসি। ভাগ্য সবসময়ে আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। ২৪ বছর বয়সে আমি পেশাদার কোচ হয়ে যাই।”
বার্সেলোনার অনূর্ধ্ব ১৮ মহিলা দলকে কোচিং করান জোয়ান। সেই শুরু। পরে স্পেনের জাতীয় দলের কোচ হিসেবে কাজ করেন তিনি। স্পেনের অনূর্ধ্ব ১৬ পুরুষ দলকে নিয়ে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। মাঝে কয়েকবছর হাঙ্গেরিতে কোচিং করেছেন জোয়ান। এখন তিনি কাতালান কোচেস স্কুলের ডিরেক্টর।
পেশার তাগিদে মানুষ পৌঁছে যায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। স্মৃতিচারণ করে জোয়ান বলছেন, ”একবার স্পেনের জাতীয় দল নিয়ে আমি ইস্তানবুলে গিয়েছিলাম। সেই সময়ে কার্লেস ওখানেই ছিল। দুই ভাইয়ের দেখা হয়েছিল। একে সমাপতনই বলব।”
কার্লেসরা চার ভাই, এক বোন। ভাইদের মধ্যে বড় ইস্টবেঙ্গল কোচই। জোয়ান রসিকতা করে বলেন, ”আমাদের বড় পরিবার। খুব সহজেই একটা বাস্কেটবল টিম তৈরি করা সম্ভব।”
সুপার কাপের মধ্যেই আইএসএল ডার্বির দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়েছে। দাদার মুখেই ইস্ট-মোহনের লড়াইয়ের ইতিহাস শুনেছেন জোয়ান। তাই বলছেন, ”ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। আমি আশাবাদী ছেলেদের মানসিক ভাবে তৈরি করে নেবে কার্লেস। দাদাকে বার্সেলোনার হয়ে খেলতে দেখেছি। কোচ হিসেবেও কার্লেস আরও বেশি আকর্ষণীয়। দাদা আরও সাফল্য পাক, এই প্রার্থনাই করি।” ইতিমধ্যেই মর্যাদার ডার্বিতে দুবার জিতেছেন কার্লেস কুয়াদ্রাত। ডুরান্ড কাপের পরে সুপার কাপেও লাল-হলুদকে ফাইনালে পৌঁছে দিয়েছেন। জোয়ান বলছেন, ”দাদার কোচিংয়ে ইস্টবেঙ্গল ফাইনালে পৌঁছেছে এটা ভাবতেই আমার শিহরণ হচ্ছে। আমি নিশ্চিত বরাবরের মতোই কার্লেস এবারও ব্যতিক্রমী কাজ করবে।”
কার্লেস কুয়াদ্রাত এখন বনস্পতি হয়ে উঠেছেন এই ইস্টবেঙ্গলে। তিনি স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। তিনি গড়ছেন, তিনি জিতছেন। হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। কলিঙ্গ সুপার কাপের ফাইনালের পরে তাঁর হাজার ওয়াটের ওই মন ভালো করা হাসি দেখতে চাইছেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা। সারভেরাতে বসে স্বপ্নের লাল-হলুদ জাল বুনছেন ভাই জোয়ান অ্যালবার্ট কুয়াদ্রাতও।
[আরও পড়ুন: দিল্লিতে ‘অপারেশন লোটাস’! সরকার ফেলতে টোপ বিজেপির, চাঞ্চল্যকর দাবি কেজরির]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.