দুলাল দে: ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে (Cristiano Ronaldo) প্রথম দল থেকে বাদ দেওয়ার জন্য কিছুদিন আগে কাতার বিশ্বকাপে (Qatar World Cup) ঠিক এভাবেই তো ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন পর্তুগাল কোচ ফের্নান্দো স্যান্তোস। তফাত শুধু, সেদিন সাংবাদিক সম্মেলনে কোচ ফের্নান্দো স্যান্তোসের পাশে বসে ছিলেন না সিআর সেভেন (CR7)। কিন্তু এদিন যখন সাংবাদিক সম্মেলনে বেঙ্গালুরু কোচ সাইমন গ্রেসন ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, কেন সুনীল ছেত্রীকে প্রথম একাদশে রাখছেন না, তখন তাঁর পাশেই বসে ছিলেন বেঙ্গালুরু অধিনায়ক।
কিছুদিন আগে জাতীয় কোচ ইগর স্টিমাচ (Igor Stimac) বলছিলেন, পরের মরশুমে অবসর নিতে পারেন সুনীল। ৩৮ বর্ষীয় সুনীল অবশ্য জাতীয় কোচের বক্তব্যের কোনও উত্তর দেননি, এটা ঠিক। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে খোঁজ খবর নিয়ে যা জানা যাচ্ছে, তাঁর অবসর নিয়ে জাতীয় কোচের অগ্রিম মন্তব্য করে দেওয়াটা খুব একটা ভালভাবেও নেননি। কারণ, সাইমন তাঁকে এই মুহূর্তে প্রথম দল থেকে বাইরে রাখলেও পরের মরশুমে তাঁর ক্লাব ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং এটা এখনই বলে দেওযা যায়, কাতার এশিয়ান কাপের (Asian Cup) পর সুনীল ছেত্রী আর জাতীয় দলের জার্সি পরবেন না। অবসর নিয়ে নেবেন জাতীয় দল থেকে।
সে সব তো নাহয় দেরি আছে। আপাতত সবার লক্ষ্যে শনিবারের মহা ফাইনাল। যেখানে অনেকে মনে করছেন, আইএসএল ট্রফি (ISL Trophy) আর মোহনবাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। যদিও হেসে বললেন, “আমাকে এখনও এতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবার জন্য ধন্যবাদ। মানছি, শনিবারের ম্যাচটা মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ম্যাচটা তো খেলবে পুরো দল। তাই ট্রফি আর মোহনবাগানের (Mohun Bagan) মাঝে শুধুই সুনীল নয়, দাঁড়িয়ে আছে পুরো বেঙ্গালুরুই।” যে মুহূর্তে কোচ গ্রেসন বললেন, প্রথম দলের বাইরে থাকতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে বলা ফের্নান্দো স্যান্তোসের (Fernando Santos) কথা কি মনে পড়ে যাচ্ছিল? এবার হেসে ফেললেন সুনীল, “না, না সত্যিই সেরকম কিছু নয়। আর বিশ্বকাপের সময় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর সঙ্গে তার কোচের ঘটনার কথাটাও ভাবিনি। যদি আমার বয়স পঁচিশ হত, তাহলে অবশ্যই ভাবতাম। কিন্তু আমার বয়স এখন ৩৮। ফলে পরিস্থিতিটা মেনে নিতেই হবে।”
কিন্তু সবকিছুই কি মানা যায়? যেখানে প্রতিপক্ষ মোহনবাগান তাঁর শুরুর ক্লাবও। তিনি ভারতীয় ফুটবলের আইকন। সেই সুনীল ছেত্রী (Sunil Chhetri) ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চ ইন্ডিয়ান সুপার লিগের ফাইনালে শুরু থেকে খেলবেন কি না, তা নিয়েই বড়সড় প্রশ্ন রয়েছে। তিনি শুরু থেকে না খেললে, সেটাই যে মোহনবাগানের জন্য সবচেয়ে বড় স্বস্তির খবর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ভারতীয় ফুটবলের বার্ধক্যের বারাণসীতে পৌঁছে যাওয়া সুনীল এরকম হাইভোল্টেজ ম্যাচের আগে পুরো ব্যাপারটাকে দেখতে চাইছেন কিছুটা অন্যভাবে। “অস্বীকার করার উপায় নেই, গত দশ বছর ধরে মোহনবাগান আর বেঙ্গালুরুর লড়াইটাই ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এই মুহূর্তে সব কিছু ছেড়ে তাই মোহনবাগান-বেঙ্গালুরু ম্যচটা নিয়ে মনোসংযাগ করতে চাই। বেশি করে ভাবতে চাই, শেষ ১১টা ম্যাচে আমাদের অসাধারণ পারফরম্যান্স নিয়ে। যেভাবে আমরা লিগে ফিরে এসেছি, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বাস করুন, এর বাইরে আর কিছু ভাবতে চাইছি না। এর আগে মোহনবাগানের কাছে ক’টা হেরেছি, ক’টা জিতেছি, এগুলি সবই গৌণ। ফাইনাল ম্যাচে এগুলির কোনও গুরুত্বই থাকবে না। আমাদের কাছে আরেকটা ম্যাচ মাত্র। যেখানে যাবতীয় ইতিহাস ভুলে শুধুই মাথা ঠান্ডা রেখে ম্যাচটা খেলতে হবে।”
কিন্তু কোচের পক্ষে কি সত্যিই সম্ভব সুনীলের মতো ফুটবলারকে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে শুরুতে প্রথম দলের বাইরে রাখা? বেঙ্গালুরু (Bengaluru FC) কোচের দিকে যখন প্রশ্নটা ধেয়ে এল, গ্রেসন কিছু বলার আগেই পরিস্থিতি হালকা করে দেওয়ার জন্য মজা করে বললেন, “কোচ, আমি কিন্তু কাউকে বলিনি এরকম প্রশ্ন করতে।” সুনীলের মজায় হেসে ফেলে কোচও বললেন, “সুনীলকে প্রথম একাদশের বাইরে রাখাটা আমার কাছে রীতিমতো কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। হেড কোচ হিসেবে দলের ভালর জন্য যে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, সেটাই নিয়েছি। এই নিয়ে সুনীলের সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে। ওকে বেঞ্চে রাখার সময় বারবার করে মাথায় রাখতে হয়েছে, ওর নাম সুনীল ছেত্রী। যে কি না ভারতীয় ফুটবলের আইকন। ওর অভিজ্ঞতাকে আমার দরকার। যখন যেভাবে ব্যবহার করার, সেটাই করছি। যখন পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি, সুনীলও ব্যাপারটা ভালভাবে মেনে নেয়।”
কিন্তু সুনীল? ভারতীয় ফুটবলের আইকন প্রথম দলে নেই। সত্যিই কি তিনি পুরো ব্যাপারটা মেনে নিতে পেরেছেন? এবার উত্তর দিতে গিয়ে বেঙ্গালুরু অধিনায়কের চোয়ালটা যেন সত্যিই কঠিন হয়ে উঠল। বললেন, “যদি বলি, বাদ পড়েও আমার খারাপ লাগেনি, তাহলে সত্যি বলা হবে না। হ্যাঁ, প্রথম দল থেকে বাদ পড়ে আমারও খারাপ লেগেছে। কারণ, যে কোনও ধরনের ফুটবলেই পুরোটা সময় খেলতে চাই। কিন্তু কোচ বোঝানোর পর বুঝেছি, দলের ভালর জন্য আমার ব্যক্তিগত বিষয়কে বড় করে দেখলে হবে না। দল ভাল খেলছে। যে জুনিয়র ফুটবলাররা খেলছে, তারাও দারুণ পারফর্ম করছে। কোচ যখনই আমাকে মাঠে নামতে বলছেন, তখনই নিজের সেরাটা দিচ্ছি। দলের জন্য এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।”
কিন্তু যে দলটা ইস্টবেঙ্গলের কাছেও হেরে মানসিক ভাবে খারাপ জায়গায় রয়েছে, ঠিক কোন ম্যাচ থেকে বুঝতে পারলেন, এবারের আইএসএলেও বেঙ্গালুরু ঠিক ঘুরে দাঁড়াবে? বেঙ্গালুরু অধিনায়কের উত্তর যেন তৈরিই ছিল। বললেন, “যে মুহূর্তে প্লে-অফে চলে আসি, বুঝে যাই, আর পিছনে তাকানোর মানে হয় না। পুরো দলটা বিশ্বাস করতে শুরু করে, মুম্বইয়ের মতো দলকে যদি হারানো যায়, তাহলে অন্য দলগুলিকেও হারানো যায়। জানি মোহনবাগান ভাল দল। আমরাও কিন্তু তৈরি।”
তিনি শনিবার প্রথম দলে থাকবেন কি না, তা নিয়ে নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু মাঠে যে নামবেন সেটা নিশ্চিত। ফলে নিজের দক্ষতা বোঝাতে আরেকবার কি অতিরিক্ত উদ্বুদ্ধ হয়ে মাঠে নামবেন তিনি? মোহনবাগানের সামনে যে কাঁটা তিনিই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.