দুলাল দে: এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না!যে ম্যাচ ঘিরে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটানোর অপেক্ষায় ছিল আপামর ফুটবল সমর্থক, ম্যাচ শুরুর আগেই তার যাবতীয় আবেগ এভাবে শুষে নিয়ে যাবেন মারাদোনা (Maradona) নামক ফুটবল ঈশ্বর, ভেবেছিলেন আপনি? ফুটবলকে ঘিরে এই চিরকালীন আবেগ সাধারণ থেকে ইশ্বরের হাতে স্থানান্তরিত হওয়ায় কারও আপত্তি, কিংবা হতাশ হওয়ার কোনও অবকাশ ছিল না। কিন্তু ফুটবল ঈশ্বরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে আবেগের স্থানান্তর হল সেটাও বোধহয় কেউই মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু চাইলেই কি তা সবসময় মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়? ফলে ভারতীয় ফুটবলের সেরা মঞ্চ ইন্ডিয়ান সুপার লিগে প্রথমবারের জন্য এটিকে মোহনবাগান (ATK Mohun Bagan) এবং এসসি ইস্টবেঙ্গল (SC East Bengal) একে অপরকে হারিয়ে ইতিহাসে নাম তোলার লড়াইয়ে নামলেও সব ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করা দু’দলের সমর্থকরা দিনের শেষে এসে মিলিত হচ্ছে মারাদোনা নামক এক শোকস্তবদ্ধ সাগরে।একে তো করোনা আবহে স্টেডিয়ামে প্রবেশের অধিকার পর্যন্ত নেই। তার উপর আবেগের স্থানান্তর। মারাদোনার মৃত্যু দু’দলের সমর্থকদের এতটাই শোকবিহ্বল করে তুলেছে, “চল, হারিয়ে ফিরতে হবে,” ডার্বির আগে এইজাতীয় কথাবার্তাগুলোই যেন আর উচ্চারিত হচ্ছে না। তবু বাঙালির ডার্বি তো। হয়তো মাঠে বল গড়ালে বদলে যাবে আবহটাই।
সন্দেশ জিঙ্ঘান ছাড়া প্রথম দলে গতবারেরই ফুটবলাররা। প্রথম ডার্বির আগে এই তথ্যটুকুই হাবাসের (Antonio Lopez Habas) সুবিধা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মুহূর্তে মনে পড়বে, এটিকে মোহনবাগানের একটা ম্যাচ দেখে ফেলার জন্য সেভাবেই পরিকল্পনা শুরু করছেন এসসি ইস্টবেঙ্গল কোচ রবি ফাউলার, তখন তো প্রশ্ন আসতে বাধ্য, তাহলে ডার্বির বল গড়ানোর আগে এগিয়ে রইল কোন দল?
দু’দলের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর যুক্তি, পালটা যুক্তি ঘোরাফেরা করছে। যেমন আগেই বললাম, গতবারের সেট দলটা হাতে রয়েছে হাবাসের। আবার এসসি ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদের না দেখানোয় হাবাসের কাছে রবি ফাউলারের দল পুরোটাই রহস্যে ভরা। এটা তো রবি ফাউলারের (Robbie Fowler) দলের জন্য সামান্য হলেও এগিয়ে থাকা। তার উপর হাতে পেয়েছেন রেনেডি সিংকে। যিনি পুণে এফসিতে হাবাসের সহকারী ছিলেন। যদি উলটোদিকে দেখি, তাহলে হাবাসের ব্র্যাড ইনম্যান আবার গত মরশুমে রবি ফাউলারের কোচিংয়ে ছিলেন ব্রিসবেন রোয়ারে। ফলে দুই কোচই মাঠে নামার আগে একে অন্যর বিরুদ্ধে যথেষ্ট পরিমাণে গোপন অস্ত্রশস্ত্র জেনে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
রইল বাকি ফুটবলারদের প্রসঙ্গ। একটা কথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল, যে দলের বিদেশি ফুটবলাররা যত ভাল, আইএসএলের (ISL) ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ সেদিকেই ঝুলে পড়ে। আর এক্ষেত্রে ফাউলারের দলের বিদেশিদের জীবনপঞ্জি হাতে পেলে যে কোনও লাল-হলুদ সমর্থক লাফিয়ে উঠবেন। প্রথম দলের পিলকিংটন, মাঘোমা, ড্যানি ফক্স। তিনজনই ইপিএল খেলা ফুটবলার। স্কট নেভিল আর স্টেইনম্যান, দু’জনেই ‘এ’ লিগের ফুটবলার। বাকি রইলেন অ্যারন। যাঁর শুক্রবারের ডার্বিতে প্রথম একাদশে থাকার সম্ভাবনা কম। তাহলে কী অজানা, অচেনা একটি দলের বিদেশি ফুটবলারদের জীবনপঞ্জি দেখেই মারাত্মক ঘাবড়ে যাবেন অ্যান্তনিও লোপেজ হাবাস? কিন্তু ইতিহাস বলছে, প্রচুর বড় বড় নাম নিয়েও এর আগে অনেক দল মুখ থুবড়ে পড়েছে।
মোহনবাগানে স্টিভ ডার্বির সময়ে ফরোয়ার্ড লাইনটা একবার ভাবুন। ওডাফা-ব্যারেটো-সুনীল। সাফল্যের ভাণ্ডার শূন্য। বড় বড় নামগুলো ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় ঠিকভাবে প্রয়োগ করা যাচ্ছে কি না, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখনও পর্যন্ত এসসি ইস্টবেঙ্গলের খেলা দূর অস্ত, প্র্যাকটিসটা পর্যন্ত দেখা সম্ভব হয়নি, তাই বলা সম্ভব নয়, অল্প দিনের প্রস্তুতিতে পিলংকিংটনরা রবি ফাউলারের হাতে কী অবস্থায় রয়েছেন। যেমন হাবাসের প্রথম ম্যাচ দেখে অনেকেরই মন ভরেনি। যদিও গুরুত্বপূর্ণ ‘তিন’ পয়েন্টটা কিন্তু পকেটে। সাত মাস প্র্যাকটিসের মধ্যে না থাকায় চেনা দল নিয়েও যদি ছন্দে ফেরা সম্ভব না হয়, তাহলে শুধুমাত্র ভাল জীবনপঞ্জির উপর নির্ভর করে ফাউলার কি পারবেন শুরুর দিনেই আকর্ষণীয় ফুটবলের ফুল ফোটাতে?
প্রশ্ন এবং সন্দেহ, দুটোই এই জায়গায় এসে আবর্তিত হচ্ছে। দু’জনেই তিন ডিফেন্ডার নিয়ে শুরু করবেন। যেখানে দু’দল বিদেশি ডিফেন্ডার ড্যানি ফক্স এবং স্কট নেভিল রবি ফাউলারের প্রথম একাদশে থাকবেন। সেখানে হাবাসের তিন ডিফেন্ডারে বিদেশি বলতে একমাত্র তিরি। বাকি দু’জন সন্দেশ আর প্রীতম। সন্দেশের মতো ডিফেন্ডার দলে যোগ দেওয়ায় একজন অতিরিক্তি বিদেশি ফুটবলারের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন এটিকে মোহনবাগান কোচ। হাবাস যেরকম কোনও একজনকে অধিনায়ক নির্বাচিত করে পুরো আইএসএল খেলার ব্যাপারে আগ্রহী নন, সেখানে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামার আগেই পুরো আইএসএলের জন্য নিজের অধিনায়ক এবং সহ-অধিনায়কের নাম ঘোষণা করে দিলেন। এক্ষেত্রে রবি ফাউলারের ভাবনা হল, সিনিয়র বা জুনিয়র নয়। যে ফুটবলারের মধ্যে অধিনায়কত্ব করার মশলা রয়েছে, আর যে প্রথম একাদশে মোটামুটি নিশ্চিত, তাঁকেই বেছে নেওয়া হবে অধিনায়ক হিসেবে। সেই হিসেবেই এসেছে ড্যানি ফক্স আর পিলকিংটনের নাম।
মারাদোনার শোকে আচ্ছাদিত বাঙালির কাছে তাহলে শুক্রবারের ম্যাচের তাৎপর্য কী? সম্মানের, ঐতিহ্যের। মনে হয় না, সেই অনুভূতি, আবেগ আর কোনও কিছুর সঙ্গেই শেয়ার করা যাবে। কিন্তু নামটা যে মারাদোনা!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.