কৃশানু মজুমদার: কোচ ম্যানুয়েল দিয়াজ (Manuel Diaz) বলছেন, ”ও দুর্দান্ত খেলেছে।”
এশিয়ান অল স্টার-খ্যাত গোলকিপার অতনু ভট্টাচার্য শনিবারের আইএসএল ডার্বি (ISL Derby) দেখে বলছেন, ”অভিষেক ম্যাচটাই ছিল ডার্বি। তার উপর দল তিন গোল হজম করে ফেলেছে। এমন সময়ে খেলতে নেমে ওর কোচকে ভরসা দিয়েছে ও। একজন পরিবর্ত গোলকিপার হিসেবে নিজের ভূমিকা যথাযথ পালন করেছে। তবে এখনই আমি ওর প্রশংসা করব না। আগামী ম্যাচগুলোতেই ওর আসল পরীক্ষা।” তিনি শুভম সেন। শনিবাসরীয় বিপর্যয়ের মধ্যেও ইস্টবেঙ্গলের একমাত্র সোনালি রেখা।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দলের একনম্বর গোলকিপার অরিন্দমের চোট কতটা গুরুতর তা জানা নেই। হয়তো তাঁর চোটের পরীক্ষাও হবে। তবে এসসি ইস্টবেঙ্গলের স্পেনীয় কোচের হৃদয়ে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন উত্তরপাড়ার শুভম। ৩০ নভেম্বর ওড়িশার বিরুদ্ধে হয়তো তাঁকেই লাল-হলুদ বাহিনীর গোল আগলাতে দেখা যাবে। অন্তত দেওয়ালিখন সেরকমই।
বাঙালির চিরআবেগের ম্যাচ ২৩ মিনিটেই পকেটস্থ করে ফেলেছিল এটিকে মোহনবাগান (ATK Mohun Bagan)। রয় কৃষ্ণ গোল করা শুরু করেছিলেন। হুগো বুমোসের ঠিকানা লেখা থ্রু পাসটা লিস্টন কোলাসোর পা থেকে তুলে নিতে গিয়ে দলকে বিপন্ন করেন বহুযুদ্ধের সৈনিক অরিন্দম। অভিজ্ঞ গোলকিপারের নাগাল এড়িয়ে যাওয়া বল ধরে গোল করেন লিস্টন। লাল-হলুদ পিছিয়ে পড়ে তিন গোলে। সমর্থকদের হৃদয় রক্তাক্ত। আশঙ্কিত ভক্তরা, আরও গোল হজম করতে হবে না তো? আগের সব রেকর্ড আবার ভেঙে ফেলবে না তো আইএসএলের এই ডার্বি? বারের নীচে অরিন্দম খোঁড়াচ্ছেন, তখনই ক্যামেরা প্যান করে ধরল শুভমকে। মাঠে নামার জন্য তৈরি হচ্ছেন। অতনু বলছেন, ”শুভম তো মানসিক ভাবে তৈরিই হয়ে গিয়েছিল। ও জেনেই মাঠে নেমেছে যে কারওর থেকে আর সেভাবে সাহায্য পাবে না। কারণ দল তখন তিন গোলে পিছিয়ে পড়েছে। শুভম মনকে প্রস্তুত করে ফেলেছিল এই ভেবে যে আমাকেই নির্ভরতা দিতে হবে গোলে। সেই কাজটাই ও করেছে ডার্বি ম্যাচে।”
ডার্বি তো এরকমই একটা ম্যাচ। যে ম্যাচ মুহূর্তেই একজনকে বিখ্যাত করে দেয়। আবার এই ম্যাচে ব্যর্থ হলেই খসে পড়তে হয়। শনিবাসরীয় এই হারা ম্যাচ শুভমের নাম ছড়িয়ে দিল ভারতীয় ফুটবলে। একথা বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।
এসসি ইস্টবেঙ্গলের (SC East Bengal) জার্সি পরার আগে উয়াড়ি, কালীঘাট এমএস, গুয়াহাটি এফসি, মহামেডান স্পোর্টিং, ইউনাইটেড স্পোর্টস-সহ একাধিক ক্লাবের জার্সি পিঠে তুলেছেন উত্তরপাড়ার শুভম। ইউনাইটেড স্পোর্টসে খেলেই স্পেনীয় কোচের দলে আসেন তিনি। ইউনাইটেড স্পোর্টসের কর্তা নবাব ভট্টাচার্য বলছিলেন, ”শুভম আমাদের হয়ে ২০১৪ সালে আই লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলেছে। তার পরে চার বছর কাস্টমসে খেলল। আইএফএ শিল্ডের সময়ে সংগ্রাম মুখোপাধ্যায় আমাকে এসে বলল, শুভমের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তখন আমাদের একটা গোলকিপারের দরকার ছিল। শুভমের খেলা দেখে আমার ভাল লেগেছিল। আমি তখন ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম, এত ভাল একটা প্রতিভা কি আইএসএলে জায়গা পাবে না? শুভমের কোনও এজেন্ট ছিল না। সেটাই কি আইএসএলে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়? অথচ ও যে কোনও আইএসএল ক্লাবে খেলার যোগ্য। আমার এই পোস্ট দেখে শ্রীসিমেন্টের এক কর্তা শুভমকে দলে নেয়।”
উত্তরপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালের পিছনের নেতাজি ব্রিগেড মাঠে ফুটবলের অআকখ-র পাঠ শুরু লাল-হলুদ গোলকিপারের। তাঁর সঙ্গেই খেলতেন এটিকের প্রাক্তন গোলকিপার দেবজিৎ মজুমদারও। শনিবারের ডার্বিতে এসসি ইস্টবেঙ্গলের একমাত্র উজ্জ্বল দিক এই শুভমের ছেলেবেলার কোচ অনুপ নাগ, সঞ্জয় চক্রবর্তী। ছেলেবেলায় একসময়ে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন। বিপক্ষের জালে বল জড়ানোই কাজ স্ট্রাইকারের। এখন প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারের পা থেকে বল তুলে নেন শুভম। তিলক ময়দানের ডার্বিতে একাধিক বার জনি কাউকো, রয় কৃষ্ণদের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দলকে রক্ষা করেছেন শুভম। ভরসা জুগিয়েছেন। উত্তরপাড়ার বাড়িতে বসে ছেলের খেলা দেখেছেন ষাটোর্ধ্ব মা-বাবা। সংসারের হাল ধরার জন্য একটা চাকরি খুঁজছিলেন শুভম।কাস্টমসে খেলার সময়ে তাঁকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চার বছর ধরে কাস্টমসের হয়ে খেললেও চাকরি আর পাননি।হতাশা গ্রাস করেছিল। কিন্তু ফুটবলই যে তাঁর প্রাণের আনন্দ, মনের আরাম।
এহেন শুভম গতবছরের নভেম্বর মাসে বাবা হয়েছেন। চলতি মাসের ১৭ তারিখ এক বছর বয়স পূর্ণ হল ছেলে দ্রিহানের। ১৪ নভেম্বর ছিল শুভমের জন্মদিন।বাঙালির বড় চেনা, বড় আবেগের ম্যাচে নামলেন এই নভেম্বরেই। সব অর্থেই নভেম্বর মাস তাঁর কাছে ঘটনাবহুল। ডার্বিতে বিধ্বস্ত হয়েছে এসসি ইস্টবেঙ্গল। মন ভেঙেছে সমর্থকদের। কিন্তু ডাকাবুকো গোলকিপিংয়ের জন্য হৃদয় জিতে নিয়েছেন ময়দানের তাতাই। ট্র্যাজেডির নায়ক হয়েই কি থেকে যেতে হবে তাঁকে? নাকি আইএসএলের কঠিন গ্রহে পরশপাথর হয়ে উঠবেন তিনি? সময় এর উত্তর দেবে। আপাতত স্বপ্নের খোঁজে শুভম।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.