গতবার মাত্র তিনটে ম্যাচ জিতেছে ইস্টবেঙ্গল, বিশ্বাসই হচ্ছে না 'মানোলো' দিয়াজের।
কৃশানু মজুমদার: সব ঠিকঠাক চললে চিনের কোনও একটি ক্লাবের রিমোট কন্ট্রোল হাতে হয়তো দেখা যেত তাঁকে। কিন্তু ললাটলিখন খণ্ডাবে কে? তাই হোসে ম্যানুয়েল ‘মানোলো’ দিয়াজের (Jose Manuel ‘Manolo’ Díaz) ঠিকানা বদলে গেল। চিন নয়, ভারতীয় ফুটবলের দুনিয়ায় নতুন অতিথি তিনি। অভিজ্ঞ স্পেনীয় কোচের হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে এসসি ইস্টবেঙ্গলের (SC East Bengal) দায়িত্ব।
এবারের আইএসএল (ISL) শুরুর আগেই নাটকীয় পটপরিবর্তন লাল-হলুদে। ক্লাব ও বিনিয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা অচলাবস্থা কাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দেশীয় ফুটবলারদের সই করিয়ে নেওয়া হয়। ইস্টবেঙ্গলের বিদেশি ফুটবলার নির্বাচনের দিকে যখন সবার নজর, ঠিক তখনই ‘কাহানি মে টুইস্ট’। বুধবার সন্ধেয় আচম্বিতেই জানিয়ে দেওয়া হল, লিভারপুল কিংবদন্তি রবি ফাউলারের বদলে কোচ করা হচ্ছে স্পেনীয় ম্যানুয়েল দিয়াজকে। রিয়াল মাদ্রিদের ‘ক্যাস্টিয়া’ দলের দায়িত্ব সামলানো কোচ সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে মাদ্রিদ থেকে বললেন, “দিনকয়েকের মধ্যে অত্যন্ত দ্রুত বদলে গেল সবকিছু। আমার তো যাওয়ার কথা ছিল চিনে। ইস্টবেঙ্গলের প্রস্তাব পেয়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।” দীর্ঘ কুড়ি বছরের কোচিং জীবন তাঁর। গত রবিবারই তিনি চিনের ক্লাবের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বহুবার জিজ্ঞাসা করার পরেও চিনের ক্লাবের নাম বের করা গেল না তাঁর কাছ থেকে। ‘মানোলো’ দিয়াজ বললেন, “এখন আর পিছনে ফিরে তাকাতে রাজি নই। ইস্টবেঙ্গল নিয়েই আমি ভাবছি। কোন ক্লাবের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি, সেটা নিয়ে আমি আর ভাবছি না।”
লাল-হলুদের ইতিহাসে তৃতীয় স্পেনীয় কোচ তিনি। তাঁর আগে আলেয়ান্দ্রো মেনেন্দেজ কোচিং করিয়েছেন ইস্টবেঙ্গলকে। তখন অবশ্য আইএসএলের বৃত্তে ঢোকেনি একশো বছর পেরনো ক্লাব। মেনেন্দেজের পরে তাঁর একদা সহকারী মারিও রিভেরাও ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে কাজ করেছেন। লাল-হলুদ সমর্থকদের প্রিয় ‘আলে স্যর’-এর সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল ‘মানোলো’ দিয়াজের। মেনেন্দেজ স্বয়ং রিয়াল মাদ্রিদের যুব দল নিয়ে দীর্ঘসময় কাজ করেছেন। নতুন শহর, নতুন ক্লাবের চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে ইস্টবেঙ্গলের নতুন কোচ পরামর্শ নিয়েছেন পুরনো কোচের। ‘মানোলো’ দিয়াজ বলছেন, “মেনেন্দেজের সঙ্গে আমার অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিল। আমরা দু’জনেই রিয়াল মাদ্রিদে কাজ করেছি। আমি তৃতীয় দল সামলাতাম। মেনেন্দেজ দ্বিতীয়। পরে দ্বিতীয় দলের দায়িত্ব পড়ে আমার উপরে। ইস্টবেঙ্গল সম্পর্কে ভাল ভাল সব কথাই বলেছেন আলেয়ান্দ্রো।”
নতুন কোচের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, ইস্টবেঙ্গল সম্পর্কে হোমওয়ার্ক করা শুরু করে দিয়েছেন তিনি। বাঙালির চিরআবেগের ডার্বি ম্যাচের কথাও তিনি নিশ্চয় শুনেছেন আলেয়ান্দ্রোর কাছ থেকেই। সেই সব শুনেই ‘মানোলো’ দিয়াজ বলছেন, “এটাই খারাপ লাগছে কলকাতায় খেলা হবে না।” ডার্বির সময়ে বাংলার সব রাজপথ এসে মেশে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত হয় গোটা শহর। আলেয়ান্দ্রোর কাছ থেকে এই শহর সম্পর্কে শুনে একটা ধারণা মনে মনে তৈরি করেছেন ‘মানোলো’। তাই কথোপকথন চলার সময়ে বারংবার কলকাতার কথাই বলছিলেন তিনি।
গতবারের আইএসএলে দুটো ডার্বি ম্যাচেই এটিকে মোহনবাগানের (ATK Mohun Bagan) কাছে হার মেনেছে ইস্টবেঙ্গল। মেনেন্দেজ কিন্তু তাঁর প্রথম বছরে ডার্বি ম্যাচে রং ছড়িয়েছিলেন। এবার কি নতুন কোচ ডার্বির ভাগ্য বদলাতে পারবেন? সেই মেগাম্যাচের বল গড়ানোর বহু আগেই সবাধানী ‘মানোলো’ দিয়াজ বলছেন, “ডার্বি জেতা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়।”
এবারের আইএসএলের ডার্বি ম্যাচে দেখা যাবে দুই স্পেনীয় কোচের মগজাস্ত্রের লড়াই। একদিকে নবাগত ‘মানোলো’ দিয়াজ। অন্য দিকে অ্যান্তোনিও লোপেজ হাবাস। যিনি এই দেশের জলহাওয়া বেশ ভালই বুঝে গিয়েছেন। গতকাল যখন নতুন কোচের নাম ঘোষণা করল ইস্টবেঙ্গল, তখন এটিকে মোহনবাগানের স্পেনীয় কোচকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল এই কৌতূহলী প্রতিবেদক, “আপনার সঙ্গে কি ‘মানোলো’ দিয়াজের পূর্ব পরিচয় রয়েছে?” উত্তরে হাবাস বলেছিলেন, “আমি ওঁর নাম শুনেছি ঠিকই কিন্তু আমার সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্কই নেই।” কিন্তু এটিকে মোহনবাগান কোচ সম্পর্কে দিয়াজ বলছেন, “আন্তোনিও বেশ কয়েকবছর ধরে ভারতে রয়েছেন। ভারতীয় ফুটবল সম্পর্কে ওঁর ধারণা খুবই পরিষ্কার।”
গত বার নিজেদের নামের প্রতি একেবারেই সুবিচার করতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। নবাগত কোচ কথোপকথনের মাঝেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন এই প্রতিবেদককে, ”গত বার ইস্টবেঙ্গল মাত্র তিনটে ম্যাচ জিতেছে? কেন?” খুব অল্প সময়ের মধ্যে দল তৈরি করে মাঠে নামতে হয়েছিল ফাউলারের দলকে। সেই কারণেই প্রত্যাশিত ফল করা সম্ভব হয়নি স্কট নেভিল-মাঘোমাদের পক্ষে। নতুন কোচের কাছে এই উত্তর সন্তোষজনক হল কিনা, তা অবশ্য বলা সম্ভব নয়।
তবে এ কথা জোর দিয়ে বলে দেওয়াই যায়, এদেশে পা দিলেই প্রত্যাশার চাপ অনুভব করতে শুরু করবেন ‘মানোলো’ দিয়াজ। তিনি নিজেও বলছেন, ”হাতে সময় খুব কম। তবে ভাল কিছু করবো বলেই আশা রাখি।” দেশীয় প্লেয়ার নেওয়া প্রায় হয়েই গিয়েছে লাল-হলুদের। এবার পালা বিদেশি প্লেয়ারের। বিদেশি নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন কোচের উপর। তিনি বলছিলেন, “বেশ কয়েকজন প্লেয়ার বেছে রেখেছি। তবে সবাইকে বাছা হয়নি এটা ঠিক। ধীরে ধীরে সেই কাজগুলো সম্পূর্ণ করতে হবে।”
ইস্টবেঙ্গলে খেলে যাওয়া বোরহা ফার্নান্দেজকে একদা কোচিং করিয়েছেন ‘মানোলো’ দিয়াজ। আলভারো মোরাতাও তাঁর একসময়ের ছাত্র। ইউরো কাপে নিন্দুকদের নখ-দাঁতের আঁচড়ে রক্তাক্ত হয়েছিলেন মোরাতা। পেনাল্টি নষ্ট করায় তাঁকে হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। প্রাক্তন ছাত্রের প্রসঙ্গ উঠতেই সপ্রতিভ ‘মানোলো’ দিয়াজ বলছেন, “মোরাতা স্পেশ্যাল প্লেয়ার। ফরোয়ার্ড হিসেবে দলকে অনেক কিছু দেওয়ার আছে ওর। তবে গ্রেট স্কোরার বলতে যা বোঝায়, মোরাতা তা নয়।”
খেলোয়াড় জীবনে ডিফেন্সে খেলতেন ‘মানোলো’। অনেকেই মনে করছেন তাঁর সিস্টমেও বেশ জমাটি হবে। রক্ষণের উপরে জোর দেবেন নতুন ইস্টবেঙ্গল কোচ। কিন্তু এখনই সেই সব নিয়ে কথা বলতে রাজি নন দিয়াজ। বলছেন, “হাতে কীরকম প্লেয়ার রয়েছে, তার উপরই নির্ভর করে সিস্টেম।”
কোচ ফাউলারের যুগ শেষ ইস্টবেঙ্গলে। ‘মানোলো’ দিয়াজের হাত ধরে লাল-হলুদে ফিরতে চলেছে স্পেনীয় যুগ। স্পেনীয়-স্পর্শে কি সাফল্য আসবে? সময় এর উত্তর দেবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.