কৃশানু মজুমদার: ছোটবেলায় সমুদ্র সৈকতে বালির গর্তে হাত ঢুকিয়ে দেখতেন কাঁকড়া আছে কিনা। কাঁকড়া খুঁজতে গিয়ে একাধিকবার কামড়ও খেয়ে থাকবেন। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যাস বদলে গিয়েছে তাঁর। কাঁকড়ার পরিবর্তে এখন গোলের খোঁজে তিনি। কে তিনি? তিনি আর কেউ নন। তিনি মহামেডান স্পোর্টিংয়ের (Mohammedan Sporting) প্রাণভোমরা মার্কাস জোসেফ (Murcus Joseph)।
এবারের আই লিগে এখনও পর্যন্ত ১৫টি গোল করে ফেলেছেন ত্রিনিদাদ-টোব্যাগোর তারকা। শেষ ল্যাপে এসে জমে গিয়েছে এবারের আই লিগ। ১৪ মে মহামেডানের সামনে গোকুলাম। যে জিতবে এই ম্যাচ, সেই দলের শো কেসে ঢুকবে আই লিগ ট্রফি। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে রেড রোডের ধারের ক্লাব মহামেডান। গোকুলামকে হারালেই প্রথমবার আই লিগ জিতবে মার্কাস জোসেফের দল। ১৪ তারিখ সাদা-কালো সমর্থকদের চোখ থাকবে মার্কাসের পায়ের দিকে।
এবারের মেগা টুর্নামেন্টে ইতিমধ্যেই ১০ নম্বর জার্সিধারী ১৫টি গোল করে ফেলেছেন। আটবার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন। সাদা-কালো ১০ নম্বর জার্সি উজ্জ্বল আই লিগে। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে মার্কাস জোসেফ বলছিলেন, ”ছোটবেলা থেকে আমি বিচ ফুটবল খেলি। বিচ ফুটবল খেলার সময়ে ৯ আর ১০ নম্বর জার্সি পরা নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত। আমি ১০ নম্বর জার্সি দখল করে নিতাম। সেই থেকেই আমার পিঠে ১০ নম্বর জার্সি।”
ব্রাজিলের কিংবদন্তি রোনাল্ডোর (Ronaldo) বড় ভক্ত তিনি। লিওনেল মেসির চোখজুড়ানো খেলা দেখতে খুব পছন্দ করেন। মার্কাসের খেলাও দৃষ্টিনন্দন। বল পায়ে পড়লেই অন্য অবতারে ধরা দেন। ১৪ তারিখের মহামেডান বনাম গোকুলাম ম্যাচের সেনসেক্স বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। এবারের টুর্নামেন্টে মহামেডানের জার্নি নিয়ে মার্কাস হাসতে হাসতে বলছেন, ”ঠিকই বলেছেন ১৪ তারিখ তো ফাইনালই। এবারের টুর্নামেন্টে একসময়ে আমরা শীর্ষে ছিলাম। সেই পজিশন থেকে নেমে গিয়েছিলাম। এবার আবার সুযোগ এসে গিয়েছে আমাদের সামনে।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেন মার্কাস। তার পরেই দার্শনিকের মতো শোনায় মার্কাসকে। তিনি বলেন, ”ফুটবল অবশ্য এরকমই। কখনও উত্থান, কখনও পতন। কখনও মেঘ আবার কখনও রোদ্দুর। খারাপ সময় যায় আবার ভাল সময় আসে। আমার কথা যদি বলেন, তাহলে বলবো ১৪ তারিখের দিকে আমি তাকিয়ে। মোটেও টেনশন অনুভব করছি না। সতীর্থদের বলছি, ১৪ তারিখের জন্য সবাই মানসিক ভাবে তৈরি হও। আমার উপরে বেশিরভাগ চাপটাই আসবে আমি জানি। আমি সেই চাপ নিতেও প্রস্তুত। প্রত্যেককে বলছি, তোমরা তৈরি থাকো, ঝাঁপিয়ে পড়ো সবাই। বিরাট বড় একটা ম্যাচ আমাদের সামনে।”
একসময়ে গোকুলামের জার্সি পরে খেলেছেন। গোলের পর গোল করেছেন। জার্সির রং বদলে ফেলেছেন। একসময়ে যে দলের জার্সি পরে প্রতিপক্ষকে মাটি ধরাতেন, ১৪ তারিখ সেই গোকুলামের বিরুদ্ধে জীবনমরণ ম্যাচ। একসময়ের দল এখন প্রতিপক্ষ। ফুটবলারের জীবনই বোধ হয় এরকম হয়। মার্কাস হাসতে হাসতে বলছিলেন, ”একজন ফুটবলারের জীবন খুবই মজার। একটা ক্লাবে খেলতে খেলতে ভালবাসা জন্মে যায়। কখনও কখনও অবশ্য একজন ফুটবলার যা চায়, তা হয়তো ঠিকঠাক হয় না। হয়তো সেই কারণেই দল পরিবর্তন করে একজন ফুটবলার। অন্য ক্লাবে গেলেও চলতে থাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তবে আমি মনে করি দল পরিবর্তন করলে ভালবাসা নষ্ট হয় না। সম্পর্কও খারাপ হয় না। গোকুলাম ছেড়ে চলে এলেও কেরলের ভক্তরা আমাকে সাপোর্ট করবে, ভালবাসবে এটাও আমি জানি।”
গোকুলাম দুদ্দাড়িয়ে খেলছিল এবারের আই লিগ। শ্রীনিধি ডেকানের বিরুদ্ধে গতকাল জিতলেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত গোকুলাম। কিন্তু ফুটবলদেবতা হয়তো অন্যরকম কিছু ভেবে রেখেছিলেন। তাই শ্রীনিধি ডেকানের কাছে হারতে হয় গোকুলামকে। আর তার পরেই চ্যাম্পিয়নশিপের দরজা খুলে যায় মহামেডানের সামনে। প্রতিপক্ষ সম্পর্কে মার্কাস বলছেন, ”গোকুলাম খুব শক্তিশালী দল। ওরা লড়াই করতে জানে। সবাই এককাট্টা হয়ে লড়ে। একটা টিম হিসেবে ওরা খেলে। এই ধরনের টিমকে ভাঙা খুবই কঠিন। আমরাও কোনও অংশে কম যাই না। আমার মনে হয় ফাইনালে দুটো দারুণ দল খেলতে নামছে।”
কিন্তু শীর্ষ স্থান থেকে হঠাতই নেমে যাওয়ায় কি আই লিগের মাঝপথে বিশ্বাস হারিয়েছিলেন তিনি? মার্কাস বলছেন, ”আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি ফুটবল এরকমই। কখনও দেখবেন একটা দল শীর্ষে। আবার সেই দলই নেমে যেতে পারে পয়েন্ট তালিকায়। গোকুলামও তো গতরাতের আগে কোনও ম্যাচ হারেনি। ফুটবল এরকমই একটা খেলা। অনেকেই বলে থাকেন ফুটবল খুব ফানি গেম।”
এই বঙ্গে পা রাখার পরে মাটন পোলাও তাঁর অন্যতম পছন্দের ডিশ হয়ে গিয়েছে। কচুর তরকারিও নাকি চেখে দেখেছেন। সেই কথা জিজ্ঞাসা করলে হাসতে থাকেন শিশুদের মতো। রক্তের গতি বাড়িয়ে দেওয়া ম্যাচ প্রসঙ্গে তাঁর চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে। ত্রিনিদাদ-টোব্যাগোর তারকা বলেন, ”চাপ অনুভব করছি এটা কখনওই বলব না। ফুটবল আমাদের চাকরি। আমাদের রুজিরুটি। আমরা ইতিহাস তৈরি করার জন্য ঝাঁপাব। হার বা ড্রয়ের কথা মাথাতেই আনছি না। জেতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।”
সুদেভা এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে এবারের আই লিগের অভিযান শুরু করেছিল মহামেডান স্পোর্টিং। প্রথম ম্যাচেই গোল করেছিলেন মার্কাস। তার পরে টুর্নামেন্ট যত এগিয়েছে তিনিও গোল করেই চলেছেন। মার্কাস বলছেন, ”ইতিহাস তৈরির দারুণ সুযোগ আমাদের সামনে। মহামেডান স্পোর্টিং জিতলে প্রথমবার আই লিগ জিতবে। এত বড় সুযোগ কেন হাতছাড়া করা হবে।”
অতীতে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার জন্যই খবরে থাকত মহামেডান স্পোর্টিং। এবার ছবিটা বদলে গিয়েছে। মহামেডানের সাফল্যের জাদুকর বলছেন, ”আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হলে ক্লাবের প্রত্যেককে আমি উৎসর্গ করবো। প্রত্যেকে অত্যন্ত সাহায্য করেছে। স্বাধীন ভাবে আমাদের খেলতে দেওয়া হয়েছে। কোনও সময়েই চাপ অনুভব করিনি।”
মানুষকে খুশি করার জন্য তিনি খেলেন। গোল করেন। ভক্তদের মুখে হাসি ফুটলে তিনিও হাসেন। তাই মার্কাস বলছেন, ”আমি এখানে এসেছি মানুষকে খুশি করার জন্য। মহামেডান সমর্থকদের মুখে যে হাসি ফোটাতে পারছি এটাই ভাল লাগছে। আই লিগ জিতলে মহামেডানের সবাই খুব খুশি হবেন, আনন্দ পাবেন, এটা ভেবেই আমার খুব ভাল লাগছে।”
১৪ তারিখের বারুদে ঠাসা ম্যাচের জন্য তৈরি মার্কাস।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.