দুলাল দে, দোহা: সওয়া দু’ঘণ্টার যুদ্ধ শেষ। আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে কার্যত একা লড়ে গিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত থাকতে হল ট্র্যাজিক হিরো হয়েই। তিনি কিলিয়ান এমবাপে। তিনি কাতার বিশ্বকাপে আট গোলের মালিক। তিনি সোনার বুট। তিনি যুদ্ধে হেরে যাওয়া দলের ব্যর্থ সেনাপতি।
প্রেসবক্সের বাঁ-দিকে বারপোস্টের কাছে তখন উত্তাল সেলিব্রেশন করছে ৩৬ বছরের খরা কাটিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া আর্জেন্টিনা (Argentina)। উলটোদিকের পোস্টের নিচে হতাশ হয়ে গোটা ফরাসি শিবির। মুখে হাত ঢেকে কাঁদছেন লরিস। ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে গ্রিজম্যান। জিরু, ডেম্বেলেরা উপুর হয়ে শুয়ে ঘাসে। আর তিনি? মাথা নিচু করে ধুঁকতে ধুঁকতে গেলেন রিজার্ভ বেঞ্চের দিকে। আধশোয়া হয়ে শরীরটা এলিয়ে দিলেন চেয়ারে। তারপর কতক্ষণ কেটে গিয়েছে, খেয়াল নেই কারও। বেশিরভাগ সময়ই এমবাপে তাকিয়ে থাকলেন মাটির দিকে। কখনও কখনও একবার মুখ তুলে দেখলেন দূরে পোডিয়ামে রাখা ট্রফিটার দিকে।
যে ট্রফি হাতে নিয়ে, সোনার মেডেলটায় দাঁত বসিয়ে গোটা মাঠ দাপিয়ে বেড়াবেন ভেবেছিলেন, সেই ট্রফিটাই যেন মুহূর্তের মধ্যে চলে গেল অন্তত বছর চারেক দূরে। ঘাড় ঘুরিয়ে এক-আধবার কি লিও মেসিদের (Lionel Messi) সেলিব্রেশনও দেখেননি এমবাপে? সম্বিত ফিরল যখন ফিফার এক প্রতিনিধি তাঁকে ডাকতে এলেন গোল্ডেন বুট নিতে যাওয়ার জন্য। বিরক্ত ট্র্যাজিক নায়ক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলেন সেই হাত। আরও একটু এলিয়ে শুয়ে পড়লেন চেয়ারে। কয়েক মুহূর্ত বাদে উঠে দাঁড়ালেন। গোল্ডেন বুট ট্রফি নিয়ে ফটোসেশনের জন্য নির্ধারিত জায়গায় যাওয়ার সময় একবার আড়চোখে দেখলেন বিশ্বকাপের দিকে। ব্যস। ওই একবারই। এরপর প্রথা মেনে মেসি, মার্টিনেজ, এনজোদের পাশে দাঁড়িয়ে পোজ দিলেন। মুখ-চোখ থেকে বিরক্তি, হতাশা, রাগ- কাটছিল না কিছুতেই। কয়েক সেকেন্ড বাদে এমবাপে সরে এলেন সেখান থেকেও।
কিছুক্ষণ আগে মাঠে যেই মুডে দেখা গিয়েছিল এমবাপেকে, ঠিক সেভাবেই একরাশ হতাশা নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে এলেন তাঁদের কোচ দিদিয়ের দেশঁও (Didier Deschamps)। শুরুতেই জানতে চাওয়া হল, রেফারিং নিয়ে কি সন্তুষ্ট তিনি? অধিনায়ক ও কোচ – দুই ভূমিকাতেই দেশকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করানো ফরাসি বললেন, “আমি খুবই হতাশার মধ্যে রয়েছি। মনমেজাজ এক্কেবারে ভাল নেই। প্লিজ, অন্য কিছু প্রশ্ন থাকলে করুন। রেফারিং নিয়ে কিছু বলতে চাই না। লাভই বা কী? তাছাড়া এই নিয়ে বলার মতো মানসিক অবস্থাও নেই।” তাঁর কোচিংয়ে টানা দু’বার বিশ্বসেরা হওয়ার সুযোগ এসে গিয়েছিল ফ্রান্সের কাছে। অল্পের জন্য লক্ষ্যপূরণ হল না। কিন্তু যা হল, তা-ই বা কম কী?
তাঁর কোচিংয়ের এক দশকে ফ্রান্স একবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, একবার রানার্স। ২০১৪ সালে সেবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। মাঝে ২০১৬ ইউরো রানার্স, ২০২০-২১ প্রথম উয়েফা নেশনস লিগে চ্যাম্পিয়ন। সেমিফাইনালে জেতার পর ড্রেসিংরুমে এসে রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তাঁকে দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধও করে যান। ফরাসি ফেডারেশন সূত্রের খবর অনুযায়ী দু’বছর পরের ইউরো পর্যন্ত তাঁর চুক্তি নবীকরণ করা হচ্ছে। যদিও তিনি এই নিয়ে কিছু বলতে চাইলেন না। শুধু বললেন, “আপনাদের আগেই বললাম, আমার মানসিক অবস্থা এখন ভাল নেই। এই নিয়ে কিছুই বলতে চাইছি না। দেশে ফিরি, তারপর ভাবব। জানুয়ারিতে ফেডারেশন সভাপতির সঙ্গে এই নিয়ে মিটিং আছে। তখন আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। তবে চ্যাম্পিয়ন হলেও ওঁকে যা বলতাম, এখনও তাই বলব।”
রেফারি, চুক্তি নিয়ে কিছু বলতে না চাইলেও হারের একটা ব্যাখ্যা দিলেন দেশঁ। বললেন, “চোট, ক্যামেল ফ্লু গোটা টুর্নামেন্ট আমাদের ধাওয়া করল। ছেলেরা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া অনেক সিনিয়র ফুটবলারকে পাইনি। অনভিজ্ঞদের নিয়ে অনেক অঙ্ক কষে ম্যানেজ করে চলতে হয়েছে আমায়। ক্লান্তিও ছিল। কিন্তু এসব অজুহাত দিয়ে লাভ নেই। গোটা দুনিয়া চেয়েছিল ওরা জিতুক। ওদের এনার্জিও ছিল প্রচুর। অসাধারণ খেলেওছে। তবে তার থেকেও বেশি দোষ ছিল আমাদের। কয়েকটা মাত্র কারণ বললাম, আরও আছে। যা বলতে চাই না। সবথেকে বড় কথা এখন আর এসব বলে কী লাভ?”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.