জয়দীপ মুখোপাধ্যায়: হারালাম আর এক বন্ধুকে। দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ৫০ বছর তো হবেই। সেই সম্পর্কের ছেদ এভাবে পড়বে ভাবিনি। মনে পড়ছে, মাস তিন-চারেক আগেও সাউথ ক্লাবে এসেছে। ইদানীং চুপচাপ বসে খেলা দেখত। তখনই দেখেছিলাম শরীর ভেঙে গিয়েছে। একদিকে যখন প্রতিটি মানুষ করোনার আতঙ্কে আতঙ্কিত, তখন চুনীর (Chuni Goswami) চলে যাওয়া মানতে খুব কষ্ট পাচ্ছি। চুনীর মরদেহ মোহনবাগান টেন্টে যাবে না, সাউথ ক্লাবে আসবে না তা কখনও হয়! সবমিলিয়ে যেন সকলের অজান্তে খসে পড়ল একটা তারা। যার নাগাল আমরা কেউ পেলাম না।
ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর টেনিসে এল। তখন ক্রিকেট চুটিয়ে খেলছে। আমি মে মাসে শহর ছাড়তাম। ফিরতাম সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। ততদিনে কলকাতায় লিগ-শিল্ড শেষ। তাই চুনীর ফুটবল খেলা সেভাবে দেখিনি। তবে প্রচুর শুনতাম। কলকাতায় গ্ল্যামারাস স্পোর্টসপার্সন বলতে তখন চুনী। তাঁকে টেনিস খেলতে দেখে অবাক বনে গিয়েছিলাম। আরে বাবা, কী ফিটনেস। অ্যান্টিসিপেশন দারুণ। কোর্টে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নড়াচড়া দেখে স্তম্ভিত। তখন সে বহুদিন ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা সব বল কোর্টে রেখে দিত। জোর দিয়ে বলছি, যদি চুনী ছোট বয়স থেকে টেনিস খেলত তাহলে ডেভিস কাপ না খেললে আশ্চর্য হতাম। ৩০-৩৫ বছর বয়সে টেনিস শুরু করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও মোহনবাগানের হয়ে দু’জন ডবলস খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। শুধু মোহনবাগান? বহু জায়গায় দু’জনে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে গিয়েছি। কখনও ডিকেএস, কখনও রবীন্দ্র সরোবর। সব জায়গায় ডবলসে নেমে আমরাই সফল হতাম।বয়সে চুনীর চেয়ে আমি প্রায় ৫ বছরের ছোট। তাতে কী? কখন যে দু’জন দু’জনের বন্ধু হয়ে গিয়েছি জানি না।
আমার বাবা অধীপ মুখোপাধ্যায় ছিলেন মোহনবাগানের (Mohun Bagan) হকি দলের ক্যাপ্টেন। টেনিসও খেলতেন। সেই সূত্রে বাবার হাত ধরে বাচ্চা বয়স থেকে মোহনবাগানে যাতায়াত। ক্লাবের টেনিস কার্নিভ্যালে বহুবার গিয়েছি। র্যামপার্টের দিকে টেনিস কোর্টে দীর্ঘদিন প্র্যাকটিস করতাম। সব মিলিয়ে মোহনবাগান ছিল আমার রক্তে। তার উপর চুনীর মতো ‘গ্ল্যামার বয়’কে পাশে পেলে কে ছাড়তে চায়। একবার ওর সঙ্গে এক জায়গায় প্রধান অতিথি হয়ে গেলাম। তখন জাতীয় টেনিস দলের আমি নিয়মিত সদস্য। চুনীকে বললাম, বাংলা ঠিক বলতে পারি না। তুমি আমার হয়ে ম্যানেজ করে দিও। বক্তব্য রাখতে উঠেই চুনী জানিয়ে দিল, জয়দীপ ঠিক বাংলা বলতে পারে না। আপনারা ক্ষমা করে দেবেন। ব্যস, পরবর্তীকালে আমাকে আর বিশেষ কিছু বলতে হয়নি।
চুনীর গ্ল্যামার নিয়ে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি। তখন রাজ্যের মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। শিলিগুড়িতে টেনিস অ্যাকাডেমি উদ্বোধন হবে। মহেশ ভূপতি (Mahesh Bhupathi), চুনী গেল। আমরাও গেলাম। সেখানে মানুষের জনপ্রিয়তা দেখে ঠিক করলাম, চুনী অ্যাকাডেমি উদ্বোধন করবে। তাই মহেশ অনুষ্ঠানে থাকলেও অ্যাকাডেমি উদ্বোধন করিয়েছিলাম চুনীকে দিয়েই। গ্ল্যামারে চুনীর ধারেকাছে কেউ থাকবে না। খেলোয়াড় জীবনের কথা বাদ দিন, অবসর জীবনেও তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিল তুঙ্গে। অথচ সেই মানুষের শেষ বিদায় ঘটল নীরবে-নিভৃতে। মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। শেষ বিদায়ও জানাতে পারলাম না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.