সরোজ দরবার: গ্রুপের সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্কগুলো আছে বহাল তবিয়তেই। ধাপে ধাপে সম্ভাবনার জটিল নকশা। এই হলে সেই, আর ওই হলে নেই। সে সব অঙ্ক সত্যি বটে। তবে তার থেকেও একটা বড় সত্য আছে। জ্ঞানের গোলোকধাঁধায় যেমন প্রজ্ঞার পথ হারিয়ে যায়, তেমনই হিসাবশাস্ত্রের এইসব জটিলতার ভিতর সে সত্যের দেখা যেন মেলে না। অনুরাগীর পৃথিবীতে হার-জয় নয়, আজ বোধহয় মেসি (Leo Messi) নামের এক ম্যাজিককে পরিপূর্ণ উপভোগ করাই সত্যের প্রকৃত মুখ।
যদিও পরিস্থিতি তেমন বসন্তরঙিন নয়। বরং যেন বরফের চাদরের উপর দিয়ে হাঁটা। অসাবধানতায় পিছলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এদিকে বাকি পৃথিবীটায় লেগেছে দূরন্ত ঘূর্ণিপাক। মুহূর্তে মুহূর্তে কেবলই খবরের জন্ম হয়। যা বলছে, ব্রাজিল (Brazil) ইতিমধ্যেই গ্রুপের চৌকাঠ পেরিয়ে গিয়েছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo) বিতর্কের ধুলো জার্সিতে মেখেও কাজের কাজটি সেরে রেখেছেন। ওদিকে এমবাপেও ছোটাচ্ছেন তাঁর অশ্বমেধের ঘোড়া। জার্মান রক্তের তেজ ফিকে। এশিয়ার সূর্যোদয়ের সাক্ষী থেকেছে কাতার। মুশিয়ালা, গাভি, ফেলিক্সরা বলে দিচ্ছেন বদলের হাওয়া লেগেছে ফুটবলবিশ্বে। আর এতকিছুর ভিতর আর্জেন্টিনা? যেন পাহাড়ি কোনও খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আজও প্রগাঢ় বিশ্বাসে তাকিয়ে আছে সেই এক এবং অদ্বিতীয় ম্যাজিক ম্যানের দিকেই।
না, একটু বোধহয় ভুল বলা হল। কেবল আর্জেন্টিনা (Argentina) আর তার সমর্থকরা অপেক্ষায় আছে বললে অর্ধসত্য বলা হয়। অপেক্ষায় আছে তারা, যারা ফুটবল ভালবাসে। ভালবাসে মেসি নামের বিস্ময়কে। আজ আর নতুন করে বলার কিছু নেই যে, এ আসলে এক ভালবাসা রঙের গ্রহ। যেখানে গুটি গুটি এসে দাঁড়ায় তারা, রোনাল্ডো-কাফুদের ভালবেসে নেইমারদের জন্য স্বপ্ন দেখছে যারা। বুকের ভিতর ক্রিশ্চিয়ানোর দুরন্ত লাফ বাঁধিয়ে রেখেছে যারা, তারাও এ পৃথিবীর ভোরের নরম আলোয় দু-দণ্ড মুগ্ধ না হয়ে পারে না। শিল্পের যেমন দেশ হয়, আবার হয়ও না। দলের পতাকা হাতে নিয়েও তাই এই ফুটবলশিল্পীর সামনে দাঁড়াতে দ্বিধা করে না কেউই।
এই যে পৃথিবীটা একটু একটু করে গড়ে উঠেছে তা নেহাত সম্মোহনের বশবর্তী হয়ে নয়। এর নেপথ্যে আছে মেসি নামের ওই মানুষটার জীবন আর ফুটবল দর্শনও। অ্যাম্বিশন কী? এ-প্রশ্ন করা হলে হয়তো প্রায় সকলেই সাফল্যের নতুনতর গন্তব্যের কথা বলবেন। মেসি বলবেন, তিনি যেন উৎকর্ষের আরও সমীপবর্তী হতে পারেন। বলবেন, সেই সব শিল্প যেন অবিরাম খেলা করে, যা দেখে প্রতিপক্ষ কেবল তাঁর পায়ের দিকেই অপলক তাকিয়ে থাকতে পারে। চুলের কায়দা তাঁর কাম্য নয়। বাসনা নেই দানবীয় শক্তির। শুধু পায়ে একখানা বল দিলেই দেখিয়ে দেবেন যে, তিনি ঠিক কী করতে পারেন। তা দেখালেনও বটে। মেক্সিকোর (Mexico) প্রতিরোধ যখন নিখুঁত নিশানায় ভাঙলেন, সারা বিশ্ব রইল চিত্রার্পিত হয়ে। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করলেন, মাটির পৃথিবীতে অকস্মাৎ এই রংধনু নামিয়ে আনতে মেসিই পারেন। তিনি একা কী পারেন, এ প্রশ্ন আজ যেন আর তাই প্রাসঙ্গিক নয় তেমন। বরং প্রায় হেরে যাওয়া গল্পগুলোর গায়ে হাত রেখে যিনি অনায়াসে জিতিয়ে দিতে পারেন, তাঁকে রূপকথার লেখক হিসাবে বিশ্বাস করতেই ইচ্ছে করে।
ঠিক এইখানে এসেই যাবতীয় অঙ্কের বিসর্জন। হয়তো সব ঠিক হবে। কিংবা হবে না। হয়তো বিশ্বকাপ চর্যাপদের হরিণী হয়েই থেকে যাবে মেসির কাছে। সম্ভাবনার সত্যি যাই বলুক না কেন, বিশ্বাস এই যে, তিনি আজ নিজেকে উজাড় করে দেবেন। আর্জেন্টিনার অঙ্ক মিলিয়ে দিতে পারেন তিনিই। যার জন্য অপেক্ষা করে আছে গোটা বিশ্ব। অঙ্ক কঠিন সন্দেহ নেই। ফুটবল শেষ পর্যন্ত দলেরই খেলা। তবু মেসির একক ক্ষমতায় যে কী অসম্ভবের খেলা বাস্তব হয়ে উঠতে পারে, তা তো কারও অজানা নয়। স্কোলানির ছক পেরিয়েও তাই সমবেত স্বপ্নেরা জড়ো হচ্ছে ওই বাঁ পায়েই। তারা জানে, পুনরাবৃত্তিহীন জীবনে এই মুহূর্তের মূল্য ঠিক কতখানি। হয়তো শেষ বার, কিংবা নতুন কোনও শুরু। যাই হোক না কেন, এই রাত আসলে মেসি নামের সৌন্দর্যকে পুরোপুরি উপভোগ করার। সেটুকুই সত্য, বাকিটা যতখানি হিসাবের, ততখানি হিসাবের বাইরেও।
অতএব গ্রুপের যত জটিল-কুটিল ফ্যাক্টর x=মেসি ধরে কষে নিতেই আজ রাত জাগবে মেসিগ্রহের বাসিন্দারা। যেভাবে রাত অপেক্ষা করে ভোরের, ঠিক সেভাবেই তারা অপেক্ষা করবে সেই অপ্রত্যাশিত মেসি-মুহূর্তের।
আরও একবার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.