হৃদিভাজনেষু
লিওনেল মেসি,
নেদারল্যান্ডসের প্রাক্তন ফুটবলার ভ্যান ডার ভার্ট আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ”মেসির বিরুদ্ধে আমি খেলেছি। আপনি মেসিকে ধরতে পারবেন না। ওকে ফাউল করতে যাবেন, দেখবেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। তবে এখন মেসি ধীরগতির হয়ে গিয়েছে, আগের চেয়ে বেশি হেঁটে বেড়ায়।” লিওনেল মেসি আপনি শুনেও চুপ থেকেছেন।
ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে সেই অবিশ্বাস্য গোলের মালিক মার্কো ভ্যান বাস্তেন বলেছিলেন, ”মেসি কিন্তু দলের রক্ষণে অংশই নেয় না। তার মানে লড়াইটা হয়ে যাচ্ছে ১১ বনাম ১০।” বাস্তেনের কথা শুনেও আপনি কিছু বলেননি লিওনেল মেসি।
মরক্কোর বিরুদ্ধেও প্রথম একাদশে নেই রোনাল্ডো! তরুণদের পায়েই সেমিফাইনালের স্বপ্ন স্যান্টোসের
স্নায়ুর পরীক্ষা নেওয়া আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস ম্যাচের আগে ডাচ শিবিরের কোচ ভ্যান গাল বলেছিলেন, ”আমার মনে হয় আর্জেন্টিনা আমাদের ভয় পাচ্ছে। আমরা মেসিকে থামিয়ে দেব। বলের নিয়ন্ত্রণ আর্জেন্টিনা হারালে মেসি বল কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশই নেয় না।” ডাচ কোচ ভ্যান গালের কথাও আপনার কানে গিয়েছিল।
রক্তের গতি বাড়িয়ে দেওয়া ম্যাচের পরে লিওনেল মেসি আপনি মুখ খুললেন। আপনি রেগে গেলেন। মাঠের ভিতরেই ভ্যান গালকে রাগত ভাবে কিছু একটা বলতে শুরু করলেন। হল্যান্ড কোচ বিস্মিত! আপনার এমন রুদ্রমূর্তি তো আগে কেউ দেখেননি।
লিওনেল মেসি আপনি সটান জানিয়ে দিলেন, আপনাকে অসম্মান করা হয়েছিল। ভ্যান গালের কথা ভালভাবে নেননি আপনি। হল্যান্ড কোচকে আক্রমণ করে বলেছিলেন, ”ভ্যান গাল আপনি বলেছিলেন আপনারা ভাল ফুটবল খেলেন। এটা কী ধরনের খেলা? লম্বা ফুটবলারকে সামনে রেখে লং বলে খেলে গেলেন। এটা কি ভাল ফুটবল?”
মেসি, এতটা রাগতেও তো আপনাকে আগে কখনও দেখেনি ফুটবলবিশ্ব। ভ্যান গালকে পালটা দিলেন। আপনার দেশের আরেক শিল্পী ফুটবলারের অপমান, বঞ্চনার জবাবও দিয়ে গেলেন।
এবার বিশ্বকাপের মঞ্চকে অনেকে প্রতিবাদের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করছেন। ফিলিপিন্সের পতাকা উড়িয়ে মরোক্কো উদযাপন করেছে, ইরানের ফুটবলাররা জাতীয় সংগীতই গাননি। লিওনেল মেসি, আপনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সবুজ গালচেতে। বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এক ফুটবলারকে আবার মনে করিয়ে দিলেন। আপনার আগে তাঁর স্বপ্নেই যে বিভোর হয়ে থাকতেন আর্জেন্টাইনরা। তাঁরা মনে করতেন নতুন এক ভোর আসবে বুয়েনোস আইরেসে। কে আনবেন? না, হুয়ান রিকলমে।
আপনি গোল করলে সাররিয়ালিস্ট ছবি ফুটে ওঠে স্টেডিয়ামে। আকাশে তর্জনী দেখিয়ে অস্ফুটে কী সব যেন বলে চলেন। আপনার ঘনিষ্ঠরা বলে থাকেন, ঠাকুমা সিলিয়ার সঙ্গে আপনি কথা বলেন। গোল উৎসর্গ করেন তাঁকে। এখনও পর্যন্ত সেটাই হয়ে এসেছে।
নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে আপনি সবঅর্থেই এক ব্যতিক্রমী রাতের জন্ম দিলেন যে! গোল করার পরে নেদারল্যান্ডসের রিজার্ভ বেঞ্চের সামনে গিয়ে হাত দুটো কানের পিছনে নিলেন। তার পর অদ্ভুত এক ভঙ্গি করলেন। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথাই নয়, উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কে? তিনি ভ্যান গাল। কিন্তু মেসি আপনি কেন এমন করলেন? কেন? কেন?
মেসি, আপনার দেশের মিডফিল্ড জেনারেল রিকলমে অদ্ভুত ভঙ্গিতে গোল উদযাপন করতেন। আপনি এখন দশ নম্বর জার্সি পরেন। আপনার আগে তো রিকলমের পিঠেই ছিল এই ১০ নম্বর। গোল করে কানের পিছনে হাত নিয়ে উদযাপন করতেন তিনি। আর্জেন্টাইন মিডিয়া বলত, ‘টোপো গিগিও’ সেলিব্রেশন।
১৯৯৬ থেকে ২০০২- এই সময়ের মধ্যে বোকা জুনিয়র্সের হয়ে রিকলমে ১৯৪টি ম্যাচে ৪৪টি গোল করেছিলেন। অনেকেই বলবেন, ”ধুর, এ আর এমন কী!” কিন্তু গোলগুলো ছিল চোখধাঁধানো। চোখের আরাম, মনের শান্তি। সেই রিকলমে ২০০২ সালে বোকা জুনিয়র্স থেকে বার্সেলোনায় সই করলেন।
মেসি, আপনার প্রাণাধিক প্রিয় ক্লাব বার্সেলোনা। আপনি বার্সায় ফুল ফুটিয়েছেন। কিন্তু আপনার অগ্রজ রিকলমে পারেননি। ব্যর্থ তকমা নিয়ে সরে যেতে হয়েছিল তাঁকে।
বার্সার হেডস্যর তখন এই ভ্যান গাল। আপনার দেশের শিল্পী ফুটবলারকে পছন্দ হল না ডাচ কোচের। রিকলমের মতো ‘লেজি এলিগ্যান্ট’ ফুটবলার সম্পর্কে ভ্যান গাল বলে বসলেন, ”হি ডিড নট স্কোর, হি ডিড নট রান।” এখানেই থেমে থাকেননি ভ্যান গাল। তিনি বলেছিলেন, ”এটা পলিটিক্যাল সাইনিং। এর বেশি কিছু নয়।” নীরবে, নিভৃতে সেদিন চোখের জলও হয়তো ফেলেছিলেন রিকলমে। রিকলমের চোখের জলের খবর আর কে রেখেছেন!
ডাচ কোচকে প্রকাশ্যে রিকলমে কোনওদিনই অসম্মান করেননি।রিকলমে-ভ্যান গাল অধ্যায় ধামাচাপাই পড়ে গিয়েছিল। আপনি মনে রেখে দিয়েছিলেন অগ্রজর অসম্মানের কথা। সেদিন হয়তো কিছু বলতে পারেননি। কিন্তু জবাব দেওয়ার মঞ্চ হিসেবে বেছে নিলেন এবারের বিশ্বকাপকে। বর্ষীয়ান কোচের সামনে ‘টোপো গিগিও’ সেলিব্রেশন করলেন। হয়তো বলতে চাইলেন, ”মিস্টার ভ্যান গাল, রিকলমেকে নিশ্চয় মনে আছে আপনার? নিশ্চয় ভুলে যাননি ওকে? আপনার জন্য রিকলমেকে চলে যেতে হয়েছিল বার্সেলোনা থেকে।”
মেসি, বহু পুরনো সেই ঘটনা আরও একবার জীবন্ত হয়ে উঠল আপনার জন্য। রিকলমে এখন কোথায় জানা নেই।তিনি নিশ্চয় দেখেছেন আপনার এই গোল উদযাপন।খুশিও হয়েছেন হয়তো। কেউ একজন তো জবাব দিল তাঁর হয়ে!
মেসি, আপনি রাগ দেখালেন, অগ্রজর অসম্মানের বদলাও নিলেন।অগুনতি ভক্ত, দেশবাসীর কাছে আপনার নতুন এক ভাবমূর্তিও তৈরি হল। দেশের মানুষের অসম্মান, অপমান, উপেক্ষা যে সইতে পারেন না আপনি।লিওনেল মেসি, দিনের শেষে আপনি কিন্তু সব অর্থে জিতেই গেলেন।
ইতি
আপনার অনুরাগী
কৃশানু মজুমদার
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.