দুলাল দে: গত চার বছর ইরানের বিভিন্ন লোকের পিছনে পড়ে থেকেও মোবাইল নম্বর মেলেনি কলকাতা ফুটবলে ৮০-র বাদশা মজিদ বাসকারের। অনেক খোঁজ হয়েছে। বন্ধুদের মাধ্যমে চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থতার টিকিট হতে উঠে এসেছে। অবশেষে এশিয়ান কাপ কভার করতে এসে দুবাইয়ের মাটিতে প্রতীক্ষার অবসান।
এশিয়ান কাপ শুরুর দিন থেকে ইরানের ফুটবল এজেন্ট ইয়েজদি পিছনে পড়ে গেলেন ভারতীয় ফুটবলারদের নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে সাহায্য করতে। বারবার বলেছেন, একটু সাহায্য করুন। বিরক্ত হয়ে বলি, একটা শর্তে করতে পারি। আমাকে মজিদ বাসকারের মোবাইল নম্বর দিতে হবে। তিনিই দিলেন মজিদ বাসকারের নম্বর। ডায়াল করতেই অন্য প্রান্তে মজিদ বাসকার। ইরানিরা যেমন ইংরেজি বলেন, সেভাবেই শুনলাম তাঁর কথা। মজিদের সঙ্গে মোবাইলে কথোপকথন হল এমন।
প্রশ্ন: আপনিই মজিদ বাসকার? আপনি ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন?
মজিদ: হুম, আমিই মজিদ বাসকার।
প্রশ্ন: সত্য়িই আপনি মজিদ..?
মজিদ: ইয়েস। বলছি তো আমিই মজিদ বাসকার।
প্রশ্ন: শুনেছিলাম, আপনি না কি ইংরেজি বলতে পারেন না।
মজিদ: এখানে পার্সিয়ান বলি। আরবি আর ইংরেজিও বলতে পারি।
প্রশ্ন: ইরানে কার সঙ্গে ইংরেজি কথা বলেন?
মজিদ: আমি যখন ভারতে আলিগড় ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, তখন ইংরেজি শিখি। কলকাতায় থাকতে বলতাম। এখানে সামান্য যা কোচিং করি, তখনও ইংরেজি বলতে হয়। উচ্চারণ খারাপ। কাজ চালানোর মতো কথা বলতে পারি।
প্রশ্ন: জানেন কি, আপনি কলকাতা ছেড়ে আসার পর সবাই পাগলের মতো আপনাকেই খুঁজছে। সবাই আপনার সঙ্গে কথা বলা চায়?
মজিদ: কী বলছেন! এখনও কলকাতার লোক আমাকে এত ভালবাসে? তাহলে আমার সঙ্গে কেন যোগাযোগ করেনি? আমাকে কোনওদিন ফোনও করেনি।
প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে কীভাবে? ইস্টবেঙ্গল খোঁজ করেছে। কিন্তু আপনার নম্বর জানে না। ইরানের কোথায় থাকেন, সেটাও নয়। আপনার বন্ধু জামশেদ নাসিরিকেও ক্লাবকর্তা থেকে সাংবাদিকরা পাগল করে দিয়েছে আপনার নম্বরের জন্য। জামশেদও খোঁজ দিতে পারেননি।
মজিদ: (হো হো হো) ‘খোরাম শায়ার’-এ চলে আসুন। তারপর কাউকে জিজ্ঞাসা করুন, ইরানের ফুটবল বিশ্বকাপার মজিদ বাসকারকে কোথায় পাব? দেখবেন যে কেউ আপনাকে আমার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। একটা সময় ইস্টবেঙ্গলে আমি যেমন জনপ্রিয় ছিলাম, এখন ইরানে যেখানে আছি, সেই খোরাম শায়ারেও আমি জনপ্রিয়।
প্রশ্ন: জামেশদ নাসিরিও দিতে পারেনি আপনার নম্বর।
মজিদ: জামশেদ এক বছর আগে কলকাতা থেকে ইরানে এসেছিল। আমার বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পেরে ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। দেখা হয়নি। তাই আমার ঠিকানা বা নম্বর জানে না। আপনাকে অনুরোধ করছি, আমার নম্বরটা জামশেদকে দেবেন। ও কলকাতায় আছে জানি। কিন্তু আপনি আমার নম্বর কীভাবে পেলেন?
প্রশ্ন: আপনার ভাইয়ের বন্ধু ইয়েজদির থেকে।
মজিদ: ওহ।
প্রশ্ন: আমি কিন্তু এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, মজিদ বাসকারের সঙ্গে কথা বলছি। আপনার এখন বয়স কত হল?
মজিদ: ৬২। তবে এখনও ফিট আছি।
প্রশ্ন: কী করছেন?
মজিদ: আমার ভাইয়ের অফিস ‘পোস্ট ব্যাংকে’ কাজ করছি।
প্রশ্ন: পোস্ট ব্যাংক মানে? যেখানে টাকা পয়সা জমা-খরচের ব্যাপার..।
মজিদ: না, না সেরকম ব্যাংক নয়। এটা প্রাইভেট অফিস। আমার ভাই মালিক। নাম, পোস্ট ব্যাংক। এটা ইরান পুলিসের অধীনে একটা প্রাইভেট সংস্থা।
প্রশ্ন: সেটা কীরকম?
মজিদ: ধরুন, কেউ পাসপোর্ট করবে। আমরা করে দিই। কারও বাড়ির কিছু বিল মেটাতে হবে। আমরা সেগুলোও করে দিই। এমনকী বাজেভাবে গাড়ি চালিয়ে পুলিশ কেস হয়েছে। সেটা মেটানোর দায়িত্বও আমাদের।
প্রশ্ন: ৬২-তেও চাকরি?
মজিদ: হুম। যখন ফিট আছি, তখন বাড়িতে বসে থাকব কেন!
প্রশ্ন: ফুটবলের সঙ্গে এখনও জড়িত?
মজিদ: এখনও প্র্যাকটিস করি। ছোট দলকে কোচিং করাই। দলটা ‘খুজেস্তান প্রোভিন্স’ লিগে খেলে। নিজেও মাঝে মাঝে প্র্যাকটিস করি। কোচিং, অফিস-এসব নিয়েই ব্যস্ত আছি।
প্রশ্ন: মনে পড়ে কলকাতাকে?
মজিদ: হুম পড়ে। আজও ইস্টবেঙ্গলকে মিস করি। ওটাই আমার সেরা সময় ছিল।
প্রশ্ন: কেন মহামেডান স্পোর্টিং?
মজিদ: আজ মনে হয়, ইস্টবেঙ্গল ছাড়াটা ঠিক হয়নি। সেরা খেলাটা ওখানেই খেলেছি। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা আমাকে দারুণ ভালবাসত।
প্রশ্ন: তাহলে ইস্টবেঙ্গল ছাড়লেন কেন?
মজিদ: সেবছর ইস্টবেঙ্গলের ফুটবল সেক্রেটারি যিনি ছিলেন (নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না) তার সঙ্গে বনিবনা হল না। আর শান্ত মিত্র (যিনি পার্ক স্ট্রিটে ব্যাংকে কাজ করতেন) আমাদের কোচিংও করাতেন, তাঁর সঙ্গে মানাতে পারলাম না। এমন অবস্থায় মহামেডান অনেক সুযোগ সুবিধা দেবে বলল। তাই ছাড়লাম। কিন্তু সেটা আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
প্রশ্ন: কলকাতায় কাউকে মনে পড়ে?
মজিদ: জামশেদ ছাড়া পিকে ব্যানার্জি, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য আর প্রসূনকে মনে আছে। ইস্টবেঙ্গলের একজন অফিসিয়াল আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল।
প্রশ্ন: কার কথা বলছেন?
মজিদ: অরুণ ভট্টাচার্য। আমাকে আলিগড় ইউনিভার্সিটি থেকে নিয়ে এসেছিলেন। অরুণ ভট্টাচার্য আমার ভাল বন্ধু ছিলেন।
প্রশ্ন: মহামেডানে গিয়ে ফুটবলটা ভুলে গেলেন কীভাবে?
মজিদ: এখন সব কিছু ঠিক মনে নেই। ওখানে গিয়ে ফুটবলের উপর কনসেনট্রেট করতে পারছিলাম না। ইস্টবেঙ্গলে পিকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল ছিল। পরে ওরকম মানুষ পেলাম না। দেখা হলে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন প্লিজ। আচ্ছা উনি কী করছেন এখন?
প্রশ্ন: অনেক বয়স হয়েছে। বাড়িতেই আছেন।
মজিদ: আমার নম্বর দেবেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারলে আমার ভাল লাগবে।
প্রশ্ন: ঠিক কবে কলকাতা ছেড়ে ইরান ফিরে এলেন?
মজিদ: দিন, তারিখ বলতে পারব না। মনে হয়, ৯০-৯১ হবে। আমার ভাই কলকাতায় গিয়ে আমাকে নিয়ে আসে।
প্রশ্ন: শোনা যায়, জামশেদ আপনাকে দেশে পাঠানোর জন্য সাহায্য করেছেন।
মজিদ: সরাসরি নয়। আমার ভাইকে হয়তো জামশেদ খবরটা দিয়েছিল যে, আমি ভাল নেই।
প্রশ্ন: এভাবে হারিয়ে গেলেন কেন? যাঁরা আপনার খেলা দেখেছেন, তাঁরা এখনও বলেন, ভারতে খেলা সেরা বিদেশি ফুটবলার- মজিদ বাসকার।
মজিদ: ভীষণ হতাশায় ভুগতাম সেই সময়। কিছুতে মন দিতে পারতাম না।
প্রশ্ন: একটা সত্য়ি কথা জানতে চাই। জেনিফারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতেই কি আপনার কেরিয়ার শেষ?
মজিদ: কলকাতায় আমার বন্ধুর প্রতিবেশী ছিল জেনিফার। আমার জীবনে বন্ধু হিসেবে এসেছিল। আপনি যেরকম ভাবছেন, তেমন স্পেশ্য়াল বন্ধু নয়। তবে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শেষ দিকটা আমার যে কী হয়ে গেল…।
প্রশ্ন: বিয়ে করেছেন?
মজিদ: না। এখনও ব্যাচেলর। বিয়েটা আর করা হল না।
প্রশ্ন: কেন? কাউকে ভুলতে না পারার জন্য?
মজিদ: না। না। (জোরে হেসে উঠে) বিয়ে করে পরিবারকে খাওয়াব কী? যা রোজগার করি, সেটা দিয়ে কোনও মতে নিজের চলে যায়। আর একজনের দায়িত্ব নেব কীভাবে?
প্রশ্ন: ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে শতবর্ষ চলছে। ক্লাব অফিসিয়ালরা আপনাকে অতিথি করে নিয়ে যেতে চাইলে যাবেন?
মজিদ: কেন যাব না। আপনি কলকাতায় গিয়ে ইস্টবেঙ্গল অফিসিয়ালদের আমার নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলুন। তবে দেখতে হবে, তখন ফাঁকা আছি কি না। প্র্যাকটিস, অফিস নিয়ে আমি কিন্তু এখনও ব্যস্ত থাকি।
প্রশ্ন: এখন কোথায় আছেন?
মজিদ: অফিসে।
প্রশ্ন: যে অবস্থায় রয়েছেন, হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছবি পাঠানো যায়? একটাই কারণ, সবাই দেখতে চায় এখন আপনাকে ঠিক কেমন দেখতে?
মজিদ: (হো হো) ও কে। পাঠাচ্ছি।
প্রশ্ন: এশিয়ান কাপে ইরানের খেলা দেখছেন?
মজিদ: দেখছি।
প্রশ্ন: ভারতের খেলা?
মজিদ: না। দেখা হয়নি।
প্রশ্ন: এটা শেষ প্রশ্ন। গত তিরিশ বছরে একবারও কলকাতায় যেতে ইচ্ছে হয়নি?
মজিদ: না। সেভাবে হয়নি। হয়তো কারও সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে হত। আসলে খুব খারাপ অবস্থায় ভাই আমাকে নিয়ে এসেছিল। তাই পরিবারের কেউ কলকাতা যাওয়ার কথা বলেনি। তবে ইস্টবেঙ্গল ডাকলে নিশ্চয় যাব।
প্রশ্ন: ভাল থাকবেন। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
মজিদ: আপনিও ভাল থাকবেন। পৃথিবীটা ছোট। আমাদের একদিন ঠিকই দেখা হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.