শতদ্রু দত্ত: সত্যি বলতে, মারাত্মক টেনশনে ছিলাম। শুধু আমি না, মার্টিনেজও (Emiliano Martinez) ছিলেন। কিছুদিন আগে বিশ্বকাপ জিতেছেন। যেখানে মেসির পাশাপাশি ওঁর অবদানের কথাও কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। স্বাভাবিক ভাবেই পৃথিবীজোড়া আর্জেন্টিনার ফ্যানরা ওঁকে ছোঁয়ার জন্য পাগল থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর বাইরেও যাঁরা ফুটবলের সমর্থক, তাঁরাও তো এই মুহূর্তে মার্টিনেজ বলতে পাগল। ফলে ঢাকা থেকে মার্টিনেজের বিমানটা কলকাতার মাটি ছুঁতে যাওয়ার মুহূর্তে স্বাভাবিক ভাবেই একটা টেনশন ধাওয়া করছিল আমাকে। জানতাম, আর্জেন্টিনার (Argentina) বিশ্বকাপজয়ী তারকাকে দেখার জন্য বিমানবন্দরের বাইরে প্রচুর লোক থাকবেন। ভিড় হতে পারে। সবমিলিয়ে পুরো পরিস্থিতিটায় কীভাবে মার্টিনেজ রিঅ্যাক্ট করবেন সেটা নিয়েই চাপ ছিল।
বাইপাসের ধারে যখন হোটেলে উঠলাম, আমার কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই মার্টিনেজ যা বললেন, তাতেই প্রাথমিক অস্বস্তিটা কেটে গেল। ওঁর ধারণা ছিল, আর্জেন্টিনার মূল শহরের বাইরে যেমন একটু ভাঙাচোরা রাস্তা, ঘর-বাড়ির অবস্থা, হয়তো বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে কলকাতার রাস্তাঘাটও তেমন হবে। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে হোটেলে আসার সময় রাস্তা আর দুপাশের পরিবেশ দেখে মার্টিনেজ মুগ্ধ হয়ে যায়। পরের দিন সকালে মিলন মেলায় ‘তাহাদের কথা’ অনুষ্ঠানে যেভাবে ভিড়ের মধ্যে ওঁকে ছোঁয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি চলছিল, তাতে মার্টিনেজের থেকেও মনে হয় আমি বেশি চাপে ছিলাম। কারণ বেশকিছু তারকাকে হ্যান্ডেল করার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ভিড়ের ধাক্কায় তাঁদের মুড বিগড়ে গেলে তার প্রভাব পরবর্তী অনুষ্ঠানগুলিতেও পড়ে। কিন্তু আমাকে অবাক করে মার্টিনেজ বললেন, “একটুও চাপ নিও না! ফ্যানরা যদি ভালবাসার অত্যাচারই না করল, তাহলে আমরা কী ফুটবল খেললাম। আর এরকম ভিড়ে আমরা অভ্যস্ত। বরং এটা ভালই লাগে।” ওঁর এই বক্তব্য জানার পর বুক থেকে পাহাড় সমান চাপের পাথরটা যেন নেমে গেল। ‘তাহাদের কথা’ অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে ওঁকে কলকাতা ডার্বি নিয়ে বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু ওর অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল, খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাইছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি করে ইউটিউবে ‘ডায়মন্ড’ ডার্বির গ্যালারির পরিবেশ দেখাতেই মার্টিনেজ অবাক হয়ে যায়। আর এরপরই মিলন মেলায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দুই ক্লাবের সমর্থকরাই যখন মার্টিনেজকে দেখে চিৎকার করে উঠল, তখনও বুঝতে পারলেন ডার্বিকে ঘিরে কলকাতার আবহ কী হতে পারে! ফলে বিশ্বজয়ী তারকা যখন মোহনবাগান মাঠে হাজির হল, সমর্থকদের ভিড় দেখে আমার আর তখন কোনও চাপ নেই। কারণ বুঝতে পেরে গিয়েছি, মোহনবাগান মাঠের পরিবেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে মার্টিনেজ।
রিষড়ায় যেতে-আসতে সময় লেগেছে দু’ঘণ্টা-দু’ঘণ্টা করে মোট চারঘণ্টা। কিন্তু অনুষ্ঠান ছিল মাত্র তিরিশ মিনিটের। ফেরার সময় বারবার করে আমি দুঃখপ্রকাশ করছিলাম সেজন্য। কিন্তু মার্টিনেজ যে শিক্ষা দিয়ে গেল, তা চিরকাল মনে রাখব। রিষড়ায় আমার নিজের বাড়ি। সেই প্রসঙ্গে মার্টিনেজ বলল, “এই যে তুমি জীবনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরও নিজের আদি বাসস্থান ছেড়ে যাওনি, এটাই সবচেয়ে ভাল দিক।” বাড়িতে যে ঘরে বসে আমি অফিসের কাজ করি, সেই চেয়ারটায় বসে একটা গ্লাভসে মার্টিনেজ স্প্যানিশে লিখে দিয়ে গিয়েছে, ‘যখন কোনও বিষয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাববে, সঙ্গে প্রথম দিনটা মনে করবে।’
রিষড়া থেকে কলকাতা ফেরার সময় জীবনের নানা ঘটনার কথা বলছিল মার্টিনেজ, “আমি যখন খেলা শুরু করি, আমার থেকেও অনেক প্রতিভাবান ফুটবলার ছিল। অল্প টাকা হাতে আসতেই মাথা ঘুরে গিয়ে খেলা থেকে ফোকাস নড়ে যায়। জীবনে যত বড়ই হয়, পা মাটিতে রাখবে।” দু’ঘণ্টার রাস্তায় একা পেয়ে বিশ্বকাপ জেতার পর আর্জেন্টিনার বর্তমান অবস্থা জানতে খুব ইচ্ছা করছিল। কারণ ততক্ষণে ও জেনে গিয়েছে, মারাদোনাকেও আমি নিয়ে এসেছিলাম। খুব অস্বস্তির সঙ্গে দুই তারকার প্রসঙ্গে যখন জানতে চাইলাম, মার্টিনেজের উত্তর ছিল, “মারাদোনার হচ্ছে আর্জেন্টিনার ফাদার ফিগার। যদি একটু সংযমী হতেন, ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতেন। কিন্তু বিশ্বকাপটা জেতার পর মেসি কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয়।”
হোটেলে ফিরে জানতে চাইছিলেন, আমাদের দেশে এই মুহূর্তে সুপারস্টার কে। সুনীল ছেত্রীর (Sunil Chhetri) নাম বলতেই সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সুপারস্টারের নাম লিখে একটা জার্সিতে সই করে বললেন, সুনীলের জন্য ওর উপহার। যখন মাঝরাতে দেশে ফেরার জন্য বিমানবন্দরে পৌঁছলেন, তখন বললেন ওঁর ধারণা ছিল আর্জেন্টিনার জন্য সবচেয়ে বেশি সমর্থন বোধহয় বাংলাদেশে রয়েছে। কিন্তু কলকাতাতেও আর্জেন্টিনার এত সমর্থক সেটা কল্পনাই করতে পারেনি। বললেন, দেশে গিয়ে মেসিকেও জানাবে এই ঘটনাটা। ও হ্যাঁ! আর একটা কথা বলতে ভুলে গেলাম। আমার বাড়ির এক হাজার মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম দেখে খুব পছন্দ হয়েছে। দেশে ফিরে স্ত্রীকে বলবে বাড়িতে এমন অ্যাকোয়ারিয়ামের ব্যবস্থা করতে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.