অরিঞ্জয় বোস: মিস্টার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ (Emiliano Martínez), কিলিয়ান এমবাপের সঙ্গে আপনার সমস্যাটা ঠিক কী? কাতারে বিশ্বজয়ের পর আপনি নাকি ড্রেসিংরুমে ফরাসি মহাতারকার উদ্দেশে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছিলেন? দুধ-সাদা ফরসা, সাড়ে ছ’ফুটের দীর্ঘাবয়ব এহেন অতর্কিত আক্রমণে থমকালো একটু যেন। বেশ থতমতভাবে পালটা জিজ্ঞাসা এলো, “আমি আবার এমবাপেকে নিয়ে কবে এসব করলাম? পুরোটাই ফালতু। নিখাদ গুজব।”
আচ্ছা, লিওনেল মেসির (Leo Messi) সঙ্গে আপনার তো এত সখ্যতা। ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করেন। মেসির নাম শুনলেই আপনার মুখাবয়বে দেবভক্তি প্রকাশ পায়। বলুন না, মেসি পরের বিশ্বকাপটা খেলছেন কিনা? শুনে এবার চিলতে হাসি ফোটে আর্জেন্টিনার মহাতারকার ঠোঁটে। স্মিতহাস্যে বলে ফেলেন, “মেসিকেই প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করলে ভাল হত না? তবে আমায় যদি বলেন তাহলে বলব, ৪৫ বছর পর্যন্ত অনায়াসে ও খেলতে পারে।”
গত তিনদিনে দুই দেশ ঘুরলেন এই নিয়ে। বাংলাদেশ আর ভারতের সংস্কৃতি কী বুঝলেন? বাঙালি খাবার-টাবারের স্বাদও নিলেন। তা লাগল কেমন? স্মিত থেকে হাসির দরাজে উত্তরণ হয়। চওড়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর আসে, “দারুণ। বাংলাদেশ আর কলকাতার মিল অনেক, আপনাদের ভাষাও তো এক। কলকাতাকে প্রকৃত অনুভব করেছি বলতে পারেন আজ গোটা দিন ধরে। বাঙালি খাবার-টাবারও খেলাম। মনে থেকে যাবে সব।”
মনে থেকে যাবে শহরেরও, মনে থেকে যাবে সবকিছু। একজন বিশ্বজয়ী ফুটবলার গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে গণ-উৎসাহের এমন মুহূর্মুহূ জোয়ারের ধাক্কা সামলে কী করে এতটা অমায়িক, কী করে এতটা অবিচল থাকতে পারেন, গবেষণার বিষয়। ঝাঁকে ঝাঁকে ছবির আবদার। অটোগ্রাফ চাহিদার ঝোড়ো হাওয়া। একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য শহরের নীল-সাদা আবেগ-নদীর দুর্বার আকুতি নিয়ে আসা– কী অবলীলায় সমস্ত সামলে গেলেন ‘ডিবু’! কিন্তু শহরের বিবিধ অনুষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় থেকে গেল বুধবার রাতের ‘সংবাদ প্রতিদিন’ আয়োজিত নৈশভোজ। যেখানে উপরের কথোপকথন ছাড়াও বঙ্গ খেলাধুলোর হালফিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় শব্দবন্ধ সজোরে হেঁকে গেলেন এমি। এবং সেটাও পরিষ্কার বাংলায়। ‘খেলা হবে!’
একবার, দু’বার, তিন-তিনবার শব্দটা উচ্চারণ করলেন বিশ্বজয়ী গোলকিপার। বাইপাসের ধারের হোটেলে ‘সংবাদ প্রতিদিন’ আয়োজিত নৈশভোজে উপস্থিত অভ্যাগতরা যা শোনামাত্র হর্ষধ্বনির যে বোল তুললেন, তা বোধহয় বুয়েনস আয়ার্স থেকেও শোনা যেত! আর অনুষ্ঠানের লালিত্যও তো বড় ব্যতিক্রমী! এমি মার্টিনেজকে গত দু’দিনে কলকাতায় কেউ কুমোরটুলির কারিগরের তৈরি তাঁর গোল্ডেন গ্লাভস প্রাপ্তির পর সেই বিতর্কিত ভঙ্গিমার মাটির ভাস্কর্য উপহার দিয়েছেন বলে তো খবর নেই। যা অনুষ্ঠানের একদম শুরুতেই দিলেন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর প্রধান সম্পাদক সৃঞ্জয় বোস (Srinjoy Bose)। সঙ্গে ছিলেন আইএফএ সচিব অনির্বাণ দত্ত। এমিকে তাঁরই সেই চর্চিত প্রতিকৃতি দিয়ে তাঁরা সংবর্ধিত করলেন। এরপর অতিকায় একটা কেক এল। যেখানে বড় বড় করে লেখা–‘এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, তোমায় অফুরান শুভেচ্ছা।’ ইন্ডাসইন্ড ব্যাংকের ইস্টার্ন রিজিয়নের জোনাল হেড সৌরভ মজুমদারও ছিলেন তাঁর দলবল নিয়ে। এমিকে সংবর্ধনা দিলেন তাঁরাও।
ময়দানের নামজাদা ক্লাব ভবানীপুরের তরফে সম্রাট ভৌমিক, সঞ্জয় ঘোষ, শুভজিৎ রায়, সুরজিৎ বোস এরপর উঠলেন এমিকে সংবর্ধনা দিতে। ভবানীপুর ক্লাবের উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হল আর্জেন্টাইন দেশনায়ককে, যাঁকে ছাড়া হয়ত সুদৃশ্য বিশ্বকাপ ট্রফিটা হাতে ধরতেই পারতেন না লিওনেল মেসি (Lionel Messi)। শুধু তাই নয়, ভবানীপুর ক্লাবের জার্সিতে সইও করে দিলেন ‘ডিবু’। এবং বিশ্বজয়ী ফুটবলারের আগমনে অনুষ্ঠানলিপি যে শুধুমাত্র ফুটবলার ও ফুটবলবৃত্তে সীমাবদ্ধ ছিল, তা নয়। বাংলা ক্রিকেটের জনপ্রিয় মুখদেরও দেখা গিয়েছে। যেমন বাংলার নির্বাচক প্রধান শুভময় দাস। যেমন বর্তমান বঙ্গক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ ব্যাটিং কাণ্ডারি অনুষ্টুপ মজুমদার। এঁরা এমির অমোঘ আকর্ষণে শুধু মোহগ্রস্তের মতো ছুটেই আসেননি, বারবার আক্ষেপও করেছেন পরিবারবর্গকে নিয়ে না আসার জন্য। উপস্থিত ছিলেন মোহনবাগানের ফুটবল সচিব স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেশ টেকরিওয়াল ও শংকর রাউত। ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেল উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্তও।
আসলে এমিলিয়ানো এমনই এক নেশার নাম, যাতে ‘সুখটান’ না দিয়ে উপায় নেই। সারাদিন দৌড়ঝাঁপের পর, হাজারো ধকল সহ্যের পর, ক’জনই বা শেষে ক্লান্তি-ব্যস্ততা (বুধবার মধ্যরাতেই ফেরার ফ্লাইট ছিল এমির) উপেক্ষা করতে পারেন? কেউ না পারলেও, এমিলিয়ানো পারেন। আর পারেন বলেই পরিশেষে উপস্থিতদের উদ্দেশে বিদায়-সম্ভাষণ দিতেও ভোলেন না। ‘ডিবু’ তো শেষে বলে গেলেন, “গত দু’দিন ধরে আমার জন্য যেভাবে আপনারা ছুটে এসেছেন, যে ভালবাসা আপনারা আমাকে উপহার দিয়েছেন, তা আমি কোনও দিন ভুলব না। আশা করি আবার একদিন আমি ফিরে আসব এই শহরে। নমস্তে, নমস্কার, আপনারা ভাল থাকবেন সবাই।”
মার্টিনেজ আবার কবে আসবেন, জানা নেই। কিন্তু যে গণ-হিস্টিরিয়ার জন্ম তিনি দিয়ে গেলেন গত ৪৮ ঘণ্টায়, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তিলোত্তমার হৃদয়ে। আর সেরা খবর যদি বলেন, সেটাও তো এই শহরকেই দিনশেষে উপহার দিয়ে গেলেন এমি। যে এমবাপের সঙ্গে তাঁর আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক নিয়ে হাজার হাজার নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে, বিশ্বকাপ পরবর্তী উৎসব নিয়ে এত লেখালেখি হয়েছে, সবই গঙ্গাপারের শহরে চিরসমাধিস্থ করে গেলেন তিনি। কিলিয়ান এমবাপে (Kylian Mbappe) নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক নীরবতা যে পালন করেননি মার্টিনেজ, এই মহাপৃথিবী এতদিন জানত তো?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.