শতবর্ষে পা দিল ইস্টবেঙ্গল। ইস্টবেঙ্গল দিবস মানেই ছিন্নমূল বাঙালির আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা। গর্বের ১০০ বছরে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইন লাল-হলুদের সেরা দশ মাইলস্টোনের তথ্য দিল।
১. আসিয়ান জয়
ভারতীয় ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সাফল্য ২০০৩ জাকার্তায় ইস্টবেঙ্গলের আসিয়ান কাপ জয়। সুভাষ ভৌমিকের কোচিংয়ে। সুলে মুসার অধিনায়কত্বে। বাইচুং-ওকোরো-ষষ্ঠী দুলে-আলভিটোদের দাপটে ফাইনালে সেবারের থাই লিগ চ্যাম্পিয়ন বেকতেরো সাসানাকে হারিয়ে বিদেশের মাঠে লাল-হলুদ পতাকার উড়ান। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম-সহ এশিয়ার দশ দেশের সেরা ক্লাবও খেলেছিল। তাতেও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে প্রতিটা নকআউট ম্যাচে গোল করেন বাইচুং ভুটিয়া। পাঁচ ম্যাচে ৮ গোল করে টুর্নামেন্টের হায়েস্ট স্কোরারও তিনি।
২. টানা ছ’বছর লিগ চ্যাম্পিয়ন
তার আগে কলকাতা লিগে কোনও ক্লাব পারেনি। মোহনবাগান ১৯৬২-’৬৫ টানা চারবার লিগ পেয়েছে। মহামেডান তিনের দশকে (১৯৩৪-’৩৮) টানা পাঁচবার কলকাতা লিগ জিতেছিল। কিন্তু সব ছাপিয়ে সাতের দশকের শুরুতে টানা ছ’বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল। ১৯৭০ থেকে ’৭৫। সেই সময়ের নিরিখে অবিশ্বাস্য। বর্তমান শতাব্দীতে লাল-হলুদ টানা আট বছরও কলকাতা লিগ জিতেছে। ২০১০-’১৭। কিন্তু ততদিনে সিএফএল অতীত গরিমা হারিয়ে ফেলেছে। সত্তরের সেই ময়দানি আবেগও!
৩. প্রথম জাতীয় লিগ
আই লিগ চালুর পর ইস্টবেঙ্গলের এখনও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। তবে প্রথম জাতীয় লিগ জয় সব সময় স্মরণীয় থাকবে। ১৯৯৬-এ জাতীয় লিগ শুরুর পরের মরশুমেই মোহনবাগান চ্যাম্পিয়ন হয়। তারপর দু’বছর বাদ দিয়ে আবার জাতীয় লিগ জেতে। জাতীয় লিগের প্রথম চার মরশুমে ইস্টবেঙ্গল দু’বার রানার্স হলেও কিছুতেই কপালে ট্রফির শিকে ছিঁড়ছিল না! শেষ পর্যন্ত ২০০০-’০১ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সরকারিভাবে প্রথম ভারতসেরা হয় ইস্টবেঙ্গল। ঘরের ছেলে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের কোচিংয়ে। মাত্র কয়েকমাস আগেই মারা গিয়েছিলেন ক্লাবের প্রাণপুরুষ পল্টু দাস। লাল-হলুদ সচিবের আক্ষেপ ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব দু’বার জাতীয় লিগ জিতে ফেলল। অথচ তাঁরা একবারও জেতেননি। পল্টু দাসের আক্ষেপ ২০০১-এ যখন মিটল ততদিনে তিনিই আর ইহধামে নেই!
৪. পঞ্চপাণ্ডবের বীরগাথা
পাঁচের দশকে ইস্টবেঙ্গলের সেই পাঁচ সোনার ফরোয়ার্ড লাইন! ভেঙ্কটেশ-ধনরাজ-আমেদ খান-আপ্পারাও-সালে। যাঁদের ম্যাজিকে ১৯৪৯-’৫৩, পাঁচ বছর গোটা ভারতে ধুলো উড়িয়ে ইস্টবেঙ্গল ১০টা টপক্লাস টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন! পঞ্চপাণ্ডবের আমলেই প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে ইস্টবেঙ্গল টানা তিনবার (১৯৪৯-’৫১) আইএফএ শিল্ড জিতেছিল। লাল-হলুদের প্রথম রোভার্স কাপ (১৯৪৯), ডুরান্ড কাপ (১৯৫১), ডিসিএম ট্রফি (১৯৫২) তিনটেই জেতা পঞ্চপাণ্ডবের আমলে। এমনই তাঁদের মিলিত আক্রমণের মাহাত্ম্য ছিল যে ওই সময় ইস্টবেঙ্গল স্কোয়াডে ফরোয়ার্ডের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭। পঞ্চপাণ্ডবের বাইরে আর মাত্র দু’জন। অন্য কারও যে দরকারই পড়ত না!
৫. ইডেনে পাজকে হারিয়ে মশাল জ্বালানো
১৯৭০-এ সেটাই ছিল স্বাধীনতার পর প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে প্রথম কোনও ভারতীয় ক্লাবের বিদেশি দলকে হারানো। তীব্র নাটকীয়তার মধ্যে শেষ মুহূর্তে ম্যাচের মীমাংসা হয়েছিল। ইডেনে ৮০ হাজার দর্শকের সামনে ইরানের পাজ ক্লাবকে হারিয়ে ইস্টবেঙ্গল শিল্ড জেতে। ইরান তখন এশিয়ান ফুটবলে পাওয়ারহাউস। ১৯৬৮-এর এএফসি এশিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের অনেক ফুটবলার ছিল সত্তরের পাজ ক্লাবে। ম্যাচ শেষ হওয়ার মিনিট কয়েক আগে পরিবর্ত হিসেবে নেমে বলে তাঁর প্রথম টাচেই ঐতিহাসিক উইনিং গোল করেছিলেন পরিমল দে। জয়ের পর এমন এক দৃশ্য ইডেন গ্যালারিতে দেখা গিয়েছিল, ভারতীয় ফুটবল যা আগে কখনও দেখেনি। ক্রিকেটও না। খবরের কাগজ জ্বালিয়ে জ্বালানো হয়েছিল হাজার হাজার মশাল। তারপর থেকে মশাল লাল-হলুদের ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন।
৬. পরপর পিয়ং ইয়ং-ডক রো গ্যাং
সাতের দশকের গোড়ার ছ’বছর ইস্টবেঙ্গলের গর্বের যুগ। তার মধ্যেও ১৯৭৩ সেরার সেরা। সে মরশুমে ইডেনে আইএফএ শিল্ড এবং দিল্লিতে ডিসিএম ট্রফি তারা জেতে দু’টো জাঁদরেল বিদেশি টিমকে হারিয়ে। দু’টোই সেই সময়কার এশিয়ান ফুটবল পাওয়ারহাউস উত্তর কোরিয়ার টিম। পিয়ং ইয়ং এবং ডক রো গ্যাং। তার মধ্যে ডক রো গ্যাং ছিল আরও শক্তিশালী। ছেষট্টির বিশ্বকাপে ইউসেবিওর পর্তুগালকে কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর কোরিয়া কাঁদিয়ে ছাড়লেও শেষমেশ ৩-৫ হারে। সেই টিমের হাফডজন ফুটবলার ছিলেন ডিসিএমের ডক রো গ্যাংয়ে। যাঁরা সেমিফাইনালে ইন্দর সিংয়ের লিডার্সকে ৭-০ উড়িয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন। কিন্তু অমন ভয়ঙ্কর টিমকে ফাইনালে পরপর দু’দিন আটকে দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। তৃতীয় দিন ডক রো গ্যাং খেলতে অস্বীকার করায় ইস্টবেঙ্গলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে সংগঠকেরা। তাতেও একটুও চটেনি ডক রো গ্যাং। উলটে তারা দিল্লিতে উত্তর কোরিয়া দূতাবাসকে বলে যায়, আমাদের ইস্টবেঙ্গলের খেলার রেকর্ডিং পাঠাও। আমরা এই ইন্ডিয়ান ক্লাবের খেলার কাটাছেঁড়া করব! তার কয়েক মাস আগেই শিল্ড ফাইনালে
পিয়ং ইয়ংকে ৩-১ হারায় ইস্টবেঙ্গল। গোটা টিম এমন দুর্ধর্ষ খেলেছিল যে মোহন সমর্থকেরাও বাহবা দিয়েছিলেন।
৭. ত্রিমুকুট
১৯৭২-এ ভারতীয় ফুটবলে প্রথম ক্লাব হিসেবে ত্রিমুকুট পাওয়ার অনবদ্য কীর্তি ইস্টবেঙ্গলের। ১৯৯১ মরশুমেও ত্রিমুকুট জেতে ইস্টবেঙ্গল। নইমুদ্দিনের কোচিংয়ে। দু’টোর মাঝে ১৯৭৭-এ মোহনবাগান ত্রিমুকুট জিতেছে। কিন্তু এক মরশুমে শিল্ড-ডুরান্ড-রোভার্স জেতার প্রথম কৃতিত্ব বাহাত্তরের লাল-হলুদের। পিকের কোচিংয়ে। সুধীর-মোহন-গৌতম-সমরেশ-হাবিব-স্বপনদের ক্যারিশমায়। ’৭২-এ ত্রিমুকুট ছাড়াও ইস্টবেঙ্গল কলকাতা লিগ আর বরদলৈ ট্রফিও জেতে। পাঁচে পাঁচ!
৮. পাঁচ গোল
যার চুয়াল্লিশ বছর পরেও মোহনবাগান সাপোর্টার উমাকান্ত পালোধির আত্মার শান্তিলাভ ঘটেনি। আজও ৫-০-র উপযুক্ত বদলা নিতে পারেনি বাগান। পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালে প্রিয় মোহনবাগানকে পাঁচ গোলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হারতে দেখে অন্ধ সবুজ-মেরুন সমর্থক উমাকান্ত আত্মহত্যা করেন। কয়েক বছর আগে ইস্টবেঙ্গলকে ৫-৩ গোলে মোহনবাগান হারিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তাতেও কি উমাকান্তর আত্মা শান্তি পেয়েছে? কে জানে! পাঁচ গোলে বড় ম্যাচ জেতার পর সুভাষ ভৌমিক যখন ইস্টবেঙ্গল টেন্টে ঢুকছেন, সাপোর্টারদের আকুল আব্দার ছিল– সেদিনের মহানায়কের ডান পা তাদের বুকের উপর দিয়ে মাড়িয়ে ক্লাবে ঢুকতে হবে! এল ক্লাসিকোতেও অহরহ পাঁচ-সাত গোল হয়। কিন্তু চুয়াল্লিশ বছর আগের সেই সময় যেন কলকাতা ময়দানে থমকে গেছে।
৯. ’৭২-এ গোল না খেয়ে লিগ
১৯৭২। পিকের কোচিংয়ে ইস্টবেঙ্গল গৌরব-যুগের প্রথম বছর। শুরুতেই ইস্টবেঙ্গল এমন রেকর্ড গড়ে কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল যা ভূ-ভারতে কেউ কখনও দেখেনি। ম্যারাথন লিগ ইস্টবেঙ্গল জেতে একটাও গোল না খেয়ে! সুধীর কর্মকার-অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়-শ্যামল ঘোষ-প্রবীর মজুমদারের দুর্ভেদ্য ডিফেন্স টপকে লাল-হলুদ গোলকিপার অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গোটা লিগে কেউ একবারও পরাস্ত করতে পারেনি। অথচ পিকের তারকাখচিত লাল-হলুদে অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই স্বয়ং কোচের কথায় একটু ‘কমা’ ছিলেন। অনেক বছর পরে পিকে বলেছিলেন, “একটাও গোল না খেয়ে বাহাত্তরে লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিন ড্রেসিংরুমে টিম ফিরছে। আর আমার খাঁটি বাঙাল গোলকিপার অরুণ আমাকে বলে চলেছে, প্রদীপদা একবার সব্বাইকে কইয়া দ্যান আমি এশিয়ার সেরা গোলকিপার।”
১০. বাইচুংয়ের ডার্বি হ্যাটট্রিক
৯৮ বছরের ডার্বি ইতিহাসে একমাত্র হ্যাটট্রিক! সেই ম্যাজিকে ’৯৭ ফেড কাপ সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গল ৪-১ হারিয়েছিল মোহনবাগানকে। সাক্ষী ছিল সল্টলেক স্টেডিয়ামে হাজির ১,৩১,৭৮১ দর্শক! যে সংখ্যাটা এখনও অবধি খেলার মাঠে সর্বোচ্চ দর্শকের এশিয়ান রেকর্ড। দুই প্রধানের দুই স্টার কোচ পিকে-অমল বাকযুদ্ধে সেই ডার্বি ছিল ম্যাচের আগে থেকেই প্রবল উত্তেজনায় টইটুম্বুর। অমল দত্তর ডায়মন্ড সিস্টেমে খেলে অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো তখন ছুটছে মোহনবাগান। কিন্তু ডার্বিতে অমলের হিরের দর্পচূর্ণ ঘটে সেই সময়ের তরুণ প্রতিভা বাইচুংয়ের বিরল হ্যাটট্রিকের ধাক্কায়। আসিয়ান জয়ের মতোই ডার্বিতে হিরের দর্পচূর্ণ ঘটানোও ইস্টবেঙ্গলের জুলাই মাসে। ১০০ বছর আগে জুলাই মাসেই তো ক্লাবটার জন্ম!
তথ্য সংকলন: গৌতম ভট্টাচার্য ও সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.