দুলাল দে: করোনা আক্রান্ত নিস্তরঙ্গ ময়দানেও আলোড়ন ফেলে দিল ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের সাম্প্রতিকতম সিদ্ধান্ত। যে আলোড়নে উঠে আসছে অমোঘ প্রশ্ন। তাহলে কি কোয়েস নামক বেড়াজাল টপকে আইএসএল খেলার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিল ইস্টবেঙ্গল, না কি বল গড়াবে আদালত পর্যন্ত? মরশুম শেষে উত্তর যাই হোক না কেন, আপাতত ইস্টবেঙ্গল আর কোয়েসকে কেন্দ্র করে ফের টান টান উত্তেজনা লাল-হলুদ তাঁবুতে। লকডাউনের সময়ও যা রীতিমতো আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩১ মে’র পরও যদি কোয়েস বিদায় না হয়, কী হবে ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের স্ট্র্যাটেজি? এতদিন ধরে লাল-হলুদ কর্তারা বলে এসেছেন, চিন্তার কোনও কারণ নেই। কোনও কারণে কোয়েস যদি তাদের ৭০ ভাগ শেয়ার ফিরিয়েও না দেয়, নতুন কোম্পানি খুলে অন্য কোনও ইনভেস্টরকে নিয়ে আইএসএল খেলার দিকে এগিয়ে যাবে ক্লাব। কিন্তু খোঁজ খবর নিতেই ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ল বেড়াল। কোয়েসের অপেক্ষা না করে ছ’মাস আগেই ‘‘ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রাইভেট লিমিটেড’’ নাম দিয়ে নতুন কোম্পানি খুলে ফেলেছেন লাল-হলুদ কর্তারা! যে কোম্পানির ডিরেক্টর হিসেবে নাম রয়েছে ক্লাব সভাপতি ডাঃ প্রণব দাশগুপ্ত এবং অন্যতম শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকারের। ছ’মাস আগে কোয়েস ইস্টবেঙ্গল ফুটবল এফসি প্রাইভেট লিমিটেডের বাইরে আরও একটা নতুন কোম্পানি খোলা হয়ে গেল, অথচ কার্যকরি কমিটির বেশিরভাগ সদস্যই পুরো বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে। যা নিয়ে রীতিমতো আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে ক্লাবের অন্দরেই। আর কোনও মন্তব্য না করে দূর থেকে কোয়েস কর্তারা পুরো ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করছেন।
খোঁজ খবর নিয়ে যা জানা গেল, গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর “ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রাইভেট লিমিটেড” নাম দিয়ে একটি নতুন কোম্পানি খোলা হয়েছে। যার আইডেন্টফিকেশন নম্বর হচ্ছে-‘ইউ৯২৪১২ডব্লিউবি২০১৯ পিটিসি২৩৪০৯২’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর-২৩৪০৯২। এই কোম্পানির মোট শেয়ার ক্যাপিটল ১০ লক্ষ টাকা। নতুন কোম্পানির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ঠিকানাই। ডাঃ প্রণব দাশগুপ্ত এবং দেবব্রত সরকারের ডিরেক্টর হিসেবে নামের পাশাপাশি শেয়ার হোল্ডার হিসেবে নাম রয়েছে চারজনের। ডাঃ প্রণব দাশগুপ্ত এবং দেবব্রত সরকারের নামে রয়েছে ৪০ শতাংশ করে শেয়ার। সচিব কল্যাণ মজুমদার এবং কার্যকরি কমিটির আরেক কর্তা সৈকত গঙ্গোপাধ্যায় নতুন কোম্পানিটিতে শেয়ার নিয়েছেন ১০ শতাংশ করে। কিন্তু নতুন কোম্পানি গঠন করতে গিয়ে কেন তা কার্যকরি কমিটিতে জানানো হল না, তা নিয়েই বেশ কিছু কার্যকরি কমিটির সদস্য বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন।
ইস্টবেঙ্গলের নতুন কোম্পানি খোলার প্রসঙ্গে অনেকে মোহনবাগানের প্রসঙ্গ টেনে আনলেও মোহনবাগানের নতুন কোম্পানি ‘মোহনবাগান ফুটবল ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’-এর সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রাইভেট লিমিটেডের অনেক পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত ম্যাকডাওয়েলের থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পরেই নতুন কোম্পানি খোলেন সবুজ-মেরুন কর্তারা। তার উপর ‘মোহনবাগান ফুটবল ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’-এর আসল মালিক হচ্ছে ক্লাবের সদস্যরা। মোট ১০০০০ শেয়ারের মধ্যে ক্লাবে সদস্যদের অধীনে ৯৯৯৯টি শেয়ার। আর কোম্পানি গঠনের ১টি মাত্র শেয়ার সভাপতি টুটু বোসের । সেখানে ইস্টবেঙ্গলের নতুন কোম্পানিতে চার কর্তাই শেয়ারহোল্ডার। এরপরেও নতুন কোম্পানি খোলার সময় আগের কোম্পানি কোয়েসের থেকে কোনও ছাড়পত্র নেননি।
নতুন কোম্পানি খোলা নিয়ে কোনওরকম অন্যায় দেখছেন না ক্লাব সচিব কল্যাণ মজুমদার। বললেন, “একটা কোম্পানি থাকলে আরেকটা খোলা যাবে না, এরকম কোনও নিয়ম নেই। তবে এই কোম্পানি এখনই সক্রিয় হচ্ছে না। যেদিন সুযোগ হবে, নতুন এই কোম্পানির দ্বারাই সব কিছু হবে। এখন দু’জন ডিরেক্টর হলেও, পরে ডিরেক্টর পদে আরও নাম বাড়ানো যেতেই পারে।” ইস্টবেঙ্গলের নতুন এই কোম্পানিটির ক্ষেত্রে কার্যকারিতায় দেখানো হয়েছে, যাবতীয় ‘স্পোর্টস এবং রিক্রিয়েশনাল অ্যাকটিভিটি।’ এখানেই উঠছে বড় প্রশ্ন। এখনও পর্যন্ত ক্লাবের যাবতীয় স্পোর্টস অ্যাকটিভিটি রয়েছে ‘কোয়েস ফুটবল এফসি প্রাইভেট লিমিটেড’-এর নামে। কোয়েসের থেকে ছাড়পত্র না পেয়ে নতুন কোম্পানিটি কীভাবে স্পোর্টস অ্যাকটিভিটি করবে?
এর ব্যখ্যাও দিচ্ছেন লাল-হলুদ কর্তারা। বলছেন, “স্পোর্টিং রাইটস নিয়ে ইতিমধ্যেই সম্মতি চলে এসেছে কোয়েসের তরফ থেকে। তাই নতুন কোম্পানির স্পোর্টিং অ্যাকটিভিটি’ নিয়ে কোনও সমস্যা থাকার কথা নয়। সবই শুনছেন কোয়েস কর্তারা। ঠিক করেছেন, এখন আর কোনও মন্তব্য করবেন না। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু সঠিক পদক্ষেপটা কী? তাদের অগোচরে রেখে নতুন কোম্পানি খোলা নিয়ে কোয়েস কর্তারা নাকি এতটাই বিরক্ত যে, স্পোর্টিং রাইটস পেয়ে গিয়েছেন বলে ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের দাবিও আর তাঁরা মানতে চাইছেন না। বলা হচ্ছে, “ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের যেটা পাঠানো হয়েছে, সেটা প্রাক্তন সিইও সুব্রত নাগের ইমেল। একটা চিঠির মাধ্যমে কখনও স্পোর্টিং রাইটস ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। তারজন্য দরকার নতুন করে চুক্তিপত্র।” ইস্টবেঙ্গল কর্তারা যদিও এই যুক্তি মানতে রাজি নন।
ইস্টবেঙ্গলের নতুন কোম্পানি খোলা নিয়ে যাবতীয় খোঁজখবর রাখছেন ফেডারেশন এবং এফএসডিএল কর্তারাও। ফেডারেশন কর্তারা বলছেন, “ফুটবল খেলার জন্য লাইসেন্সিং করা হয়েছে ‘কোয়েস ইস্টবেঙ্গল এফসি’র নামে। এবার যদি নতুন কোম্পানি দিয়ে ইস্টবেঙ্গল খেলতে চায়, তাহলে কোয়েসের ছাড়পত্র একান্তই জরুরি। সঙ্গে নতুন কোম্পানিকেও লিখিতি জানাতে হবে, আগের কোম্পানির যাবতীয় আর্থিক দায়ভার নতুন কোম্পানিকে নিতে হবে। কার কাছে কি শেয়ার আছে, আর কে কোথায় কোম্পানি করেছে, তা নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই।”
ফেডারেশনের দেখানো পথেই নতুন কোম্পানি গঠন করছে এটিকে-মোহনবাগান। মোহনবাগানের পুরনো কোম্পানি ‘মোহনবাগান ফুটবল ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং এটিকের পুরনো কোম্পানি ‘ক্যালকাটা স্পোর্টস অ্যান্ড গেমস প্রাইভেট লিমিটেড’ দু’জনেই ছাড়পত্র দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, ‘এটিকে-মোহনবাগান প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে নতুন কোম্পানিকে ফুটবল খেলার অনুমতি দিতে তাদের কোনও আপত্তি নেই। আইএসএল কিংবা আই লিগ যেখানেই খেলুক, নতুন কোম্পানির মাধ্যমে খেলতে গেলে এই কাগজপত্র লাগবেই। ফলে সকলের অগোচরে ৬ মাস আগেই নতুন কোম্পানি খুলে ফেললেও, ইস্টবেঙ্গলের যে সমস্যা মিটে যাচ্ছে বলা যাবে না। কোয়েস আর ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে সমস্যা যে আরও বাড়ল, তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.