সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: কারও চোখে তিনি ফুটবল রাজপুত্র, কারও চোখে স্বয়ং ঈশ্বর। আবার কারও চোখে তিনি স্বপ্নভঙ্গের কারিগর। তবে হাজারও বিতর্কের ঊর্ধ্বে গত শতাব্দীর সেরা ফুটবলার দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা (Diego Maradona)। তাঁর মোহময়ী প্রতিভা মুগ্ধ করেছে গোটা বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীকে। তাই দিয়েগো মারাদোনা আজও সুপারস্টার। কিন্তু শুধুই কি সাফল্য। চাঁদের যেমন কলঙ্ক আছে, মারাদোনারও ছিল। আসলে সব প্রদীপের নিচেই তো একটুখানি অন্ধকার থাকে।
৩০ অক্টোবর ১৯৬০। বুয়েনেস আইরেসের এক বসতিতে জন্ম হয় তাঁর। বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। অভাবের সংসারে থেকেও বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতেন। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভা নজরে আসে স্থানীয় বিখ্যাত ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের। ১৬ বছর বয়স হওয়ার আগেই সুযোগ পান সিনিয়র দলে। সেটাও রেকর্ড। সিনিয়র ফুটবলে প্রথম মরশুমেই আর্জেন্টিনার (Argentina) বহু সমর্থকের চোখের মণি হয়ে যায় সেই কিশোর। ডাক নাম হয়ে যায় ‘ফিওরিতো’ যার অর্থ, ফুলের মতো সুন্দর।
কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে ১৬ বছর বয়সে জাতীয় দলে সুযোগ পান ১৯৭৭ সালে। ৭৮-এর বিশ্বকাপে জাতীয় দলে সুযোগ পাননি। যা কষ্ট দিয়েছিল যৌবনে পা রাখা দিয়েগোকে। পরের বছরই আর্জেন্টিনাকে তিনি জেতান যুব বিশ্বকাপ। এর বছর তিনেকের মধ্যেই তাঁকে সই করিয়ে নেয় বার্সেলোনা (Barcelona)। ১৯৮২ সালে মারাদোনার জন্য ১১ লক্ষ পাউন্ড খরচ করে কাতালান ক্লাবটি। তবে বার্সার জার্সিতে তেমন সাফল্য আসেনি। দুই মরশুম পরে মারাদোনাকে কিনে নেয় নাপোলি। ইটালির ফুটবলে তখন মধ্যমানের ক্লাব ছিল সেটি। কিন্তু মারাদোনা যোগ দেওয়ার পর ভাগ্য বদলে যায় নাপোলির। প্রায় একার দক্ষতায় এসি মিলান, ইন্টার, জুভেন্তাসের মতো বড় বড় ক্লাবকে পিছনে ফেলে নাপোলিকে চ্যাম্পিয়ন করে দেন দিয়েগো।
মারাদোনার জীবন বদলে দেয় ১৯৮৬’র বিশ্বকাপ। বা পায়ের জাদুতে গোটা বিশ্বের মনজয় করেন দিয়েগো। খেলার মাঠে তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ মুগ্ধ করত বিপক্ষের ফুটবলারদেরও। নিমেষে ড্রিবল, ডস, জোরাল শট। দিয়েগোর পা থেকে কি না দেখেছে ফুটবলবিশ্ব। তবে সেবারের বিশ্বকাপেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি তাঁর। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর করা প্রথম গোলটি আজও বিখ্যাত হয়ে আছে ‘হ্যান্ড অফ গডে’র (Hand of God) জন্য। ইংল্যান্ডের আগুয়মান গোলরক্ষক পিটার শিল্টনের মাথার উপর দিয়ে তিনি যেভাবে বিপক্ষের জালে বল জড়ান, এক নজরে পিছন থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে সেটি হাত দিয়ে করা। রেফারি বোঝেননি। ইতিহাসে কালজয়ী বিতর্কের সৃষ্টি করেছে মারাদোনার সেই ‘হ্যান্ড অফ গড’।
কয়েক মিনিট আগেই যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন নিজে, সেই বিতর্ক আবার নিমেষে ভুলিয়েও দিয়েছেন একই ম্যাচে ‘শতাব্দীর সেরা গোল’ করে। ‘হ্যান্ড অফ গডে’র পরই ইংল্যান্ডের ৬ জন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে তাঁর করা গোল এখনও গত শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে বিবেচিত হয়। সেবারেই ফাইনালে ৩-২ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয় আর্জেন্টিনার। সোনার বুট পান মারাদোনা। নাম লিখিয়ে ফেলেন চিরন্তন কিংবদন্তিদের খাতায়। ২০০০ সালে পেলের সঙ্গে যৌথভাবে তাঁকে শতাব্দীর সেরা ফুটবলার হিসেবে ঘোষণা করে ফিফা (FIFA)।
কিন্তু সাফল্যের শীর্ষে থেকে পতনের পথে বেশি সময় নেননি দিয়েগো। উশৃঙ্খল ব্যক্তিগত জীবন আর মাদকে আসক্তি বারবার তাঁর জীবনে ডেকে এনেছে বিতর্ক। কখনও একাধিক নারী সঙ্গ, কখনও নিষিদ্ধ মাদক সেবন। কখনও ইটালি, মেক্সিকোর ড্রাগ মাফিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ, বারবার জড়াতে হয়েছে আইনি বিপাকেও। ১৯৯১ সালে মাদক সেবনের জন্য ইটালির ফুটবল থেকে ১৫ মাসের জন্য নির্বাসিত হতে হয় তাঁকে। সেখান থেকে ফিরে যান আর্জেন্টিনায়। বিমানবন্দরে ধরা পড়েন কোকেন-সহ। ১৯৯৪ সালে সাংবাদিককে গুলি করার অপরাধে সাসপেন্ডেড জেল হয় তাঁর। না হাজতে রাত কাটাতে হয়নি। জরিমানা দিয়ে ছাড় পেয়েছেন। ১৯৯৪ দেশে বিশ্বকাপের মাঝপথে নিষিদ্ধ ড্রাগ সেবনের জন্য দেশে ফিরতে হয়। ২০০০ সালের পর অতিরিক্ত মাদক সেবনের জেরে বেড়ে যায় ওজন। ২০০৪ সালে একবার হার্ট অ্যাটাকও হয়। বহুবার প্রকাশ্যে এসেছে অসংলগ্ন ব্যবহার, বহুবার জড়িয়েছেন আইনি বিপাকে। সব কিছু পেরিয়ে ফিরেও এসেছেন।
২০০৮ সালে খানিকটা চমক দিয়েই মারাদোনাকে জাতীয় দলের কোচ করে আর্জেন্টিনা। দল ভালই খেলছিল। কিন্তু ২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে পরাস্ত হয় নীল-সাদা ব্রিগেড। তারপরই পদত্যাগ। একাধিক ক্লাবে কোচিং করিয়েও সাফল্য আসেনি। তবে, সব ব্যর্থতা, সব বিতর্ক ছাপিয়ে মারাদোনা মারাদোনাই।বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি অনুরাগীর চোখে তিনি ঈশ্বর। ফুটবল রাজপুত্রের প্রয়াণে তাই আজ মন খারাপ প্রত্যেক ফুটবলপ্রেমীর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.