রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: আবার বছর বারো পরে/ তার সাথে দেখা হয় যদি/ হয়তো ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ঘাসে/ আগস্ট মাসের শেষে…।
জীবনানন্দ দাশকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর চেনার কথা নয়। জানার কথা নয় বঙ্গ কবির অমর সৃষ্টি। দু’জনের জন্ম ভূখণ্ড আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা, ভাষা ভিন্ন। এক প্রজন্মেরও নন দু’জন। কিন্তু পৃথিবীজোড়া সৃষ্টির ময়দান আর কবে কোন ভাষাতে সীমাবদ্ধ থেকেছে? শিল্পীর হাতে কলম থাকুক কিংবা পায়ে ফুটবল, শিল্পের ভাষা চিরকালই একে অন্যের পরিপূরক, অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধনহীন গ্রন্থির সৃষ্টিকর্তা। আর তাই শুক্রবার রাতে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড প্রত্যাবর্তনে জীবনানন্দের অমর শব্দগুচ্ছকে ইচ্ছেমতো ওলটপালট করে নেওয়ার ধৃষ্টতায় অপরাধ নেই বোধহয়। বরং তা সময়োপযোগী, যথাযথ।
বা-রো-টা বছর! বারো বছর পর আবার ফুটবলবিশ্বের বিখ্যাত লাল জার্সিতে তো ফিরতে চলেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo)! আবার সেই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে! সেই কবে ২০০৯ সালে পর্তুগিজকে তাঁর শৈশবের বাসস্থান, যৌবনের চারণভূমি ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। রেকর্ড আশি মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে। রেড ডেভিলস সমর্থককুলকে কাঁদিয়ে। মাঝের সময়টা রিয়ালের সাদা জার্সি। জুভেন্তাসের সাদার উপর কালো ডোরা। লা লিগায় দুর্বার, সেরি আ-কে শাসন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ‘লা ডেসিমা’– কী হয়নি? কিন্তু রোনাল্ডোর মন? সিআরের মন থেকে ইউনাইটেডকে কোথায় সরাতে পেরেছে রিয়াল-জুভেন্তাস? এই তো, বছর দু’য়েক আগে ইউনাইটেডে (Manchester United) গিয়ে ইনস্টাগ্রামে একটা ছবি পোস্ট করেছিলেন রোনাল্ডো। লিখেছিলেন, ‘আজও এই ক্লাবে এলে মনে হয়, বাড়ি ফিরলাম।’ ঠিকই। আজও রোনাল্ডোকে ইউনাইটেডে ফেরাতে অবসরের দীপপুঞ্জে বিশ্রাম নেওয়া কোনও এক স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসনের একটা ফোনই তো যথেষ্ট!
গভীর রাতের দিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় গোটা কয়েক ভাইরাল ভিডিওয় দেখা গেল, বিলেতের অচেনা পাবে রেড ডেভিলস সমর্থকরা মোটামুটি আপন বেগে পাগলপারা। চিৎকার করতে করতে তাঁরা গাইছেন, ‘ক্রিশ্চিয়ানো, উইল লাভ ইউ’, কেউ ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলছেন। ভাবা যাবে না, এঁরাই গত রাত থেকে কী অশান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আসলে ইউনাইটেড সিআর-যুদ্ধে ঢুকেছে এ দিন দুপুরে, সকাল পর্যন্ত ছিল এক এবং একমাত্র সিটি। রোনাল্ডো যখন তুরিনের মাঠে গিয়ে জুভেন্তাস (Juventus) সতীর্থদের ‘গুডবাই’ বলে চার্টার্ড ফ্লাইটে মেদেইরা ফিরে যান, তখনও। কাকপক্ষীতেও জানতে পারেনি, অজান্তে আরও এক ম্যাঞ্চেস্টার তৈরি হচ্ছে, অনুগত শিষ্যকে বোঝাতে ময়দানে যারা নামিয়ে দিয়েছে পুরনো দ্রোণাচার্যকে!
Welcome , @Cristiano #MUFC | #Ronaldo
— Manchester United (@ManUtd) August 27, 2021
সিটির সমস্যা হচ্ছিল, ২৫ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সফার ফি নিয়ে। জুভেন্তাস চাইছিল অর্থটা। সিটি দিতে চাইছিল না। ততক্ষণে স্যর অ্যালেক্সের ফোন চলে গিয়েছে রোনাল্ডোর কাছে। কিছু পরপর ক্লাবের ফোন। এবং দুপুর দুপুর ইউনাইটেড কোচ ওলে গানার সোলজায়ারের, “রোনাল্ডোর সঙ্গে কথা চলছে,” বলার আধ ঘণ্টার মধ্যে হাল ছেড়ে সিটির বিদায় এবং ইউনাইটেডের আগমন-আস্ফালন! শেষে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দু’বছরের চুক্তিতে ২০ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সপার ফি দিয়ে ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া।
সময় সময় মনে হচ্ছে, সিআর-উপাখ্যান না থাকলেই বোধহয় দলবদলের কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যেত। দলবদল ঘিরে এমন শিহরণ, এমন রোমাঞ্চ বহু দিন দেখেনি বিশ্বফুটবল। যে দলবদলে মেসি বার্সা ছেড়েছেন, লুকাকু চেলসিতে এসেছেন, এমবাপে শয়নে-স্বপ্নে রিয়াল দেখছেন, সেখানে তিনি- রোনাল্ডো নিম্নবিত্ত সেরি আ-তে অবহেলায় পড়ে থাকবেন? হয় কখনও? কেউ কেউ ভাবতে পারেন, অর্থের দিক থেকে লাভবান হবেন না রোনাল্ডো। কিন্তু ফুটবল-সায়াহ্নে পৌঁছে কে আর অর্থ চায়? তখন অপার শান্তিই প্রলোভন, ‘ধাত্রীভূমি’ই আকর্ষণ। মেসি চাননি অর্ধেক মাইনেতে বার্সায় থেকে যেতে? রোনাল্ডোও চেয়েছেন। চেয়েছেন, ছেলেবেলাকে ফিরে পেতে, প্রথম আলোয় ফিরে যেতে, ফিরে যেতে সেই ক্লাবে যারা তাকে লিকলিকে কিশোর থেকে মূর্তিমান ফুটবল-দানব তৈরি করেছিল।
ওয়েলকাম হোম, মিস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.